একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
এই পৃষ্ঠায়
- 1 একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো :
- 2 একনায়কতন্ত্র কী :
- 3 একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য :
- 3.1 (ক) ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরােধী :
- 3.2 (খ) স্বাধীনতাহীন আইন ও বিচার বিভাগ :
- 3.3 (গ) সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদের জন্মদাতা :
- 3.4 (ঘ) বিরোধীদের কণ্ঠরোধ :
- 3.5 (ঙ) একদল একনেতা :
- 3.6 (চ) ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ :
- 3.7 (ছ) স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা :
- 3.8 (জ) গুপ্তচর বাহিনীর উপস্থিতি :
- 3.9 (ঝ) প্রচার মাধ্যমের বাকরোধ :
- 3.10 (ঞ) জনগণের স্বাধীনতা হরণ :
- 3.11 (ট) বলপ্রয়ােগ :
- 3.12 (ঠ) সরকারের নীতি প্রণয়ন :
- 3.13 (ড) রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক :
- 3.14 (ঢ) রাষ্ট্র ও সরকারের অভিন্নতা :
- 3.15 (ণ) সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র :
- 3.16 মূল্যায়ন :
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো :
আরো পড়ুন – ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে
একনায়কতন্ত্র কী :
একনায়কতন্ত্র হল একটি অতি প্রাচীন রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ। তত্ত্বগতভাবে একনায়কতন্ত্র হল গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা।অর্থাৎ যে সরকার বা শাসনব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে।
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য :
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে আলোচিত হল –
(ক) ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরােধী :
একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকার করা হয় না। জনসাধারণকে বলা হয় To believe, to obey, to fight. এখানে ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোন ধরনের অধিকার স্বীকার করা হয় না।
একনায়কতন্ত্রের মূল মন্ত্র হল রাষ্ট্রনায়কের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও আনুগত্য।
(খ) স্বাধীনতাহীন আইন ও বিচার বিভাগ :
একনায়কতন্ত্রে নায়কই হলেন সর্বেসর্বা। তাঁর নির্দেশই হল আইন। তা অমান্য বা সমালোচনা করার অধিকার কারোর নেই।
এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভা ও বিচার-বিভাগের অস্তিত্ব থাকে বটে, কিন্তু এই দুই বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষমতা অস্বীকৃত।
(গ) সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদের জন্মদাতা :
একনায়কতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদের জন্ম দেয় ।এই ব্যবস্থায় শান্তি, মৈত্রী, সৌভ্রাতৃত্বকে সমর্থন করা হয় না।
মুসোলিনি আন্তর্জাতিক শান্তিকে কাপুরুষের স্বপ্ন বলে অভিহিত করেছিলেন । তাঁর বক্তব্য ছিল স্ত্রীলোকের কাছে মাতৃত্ব যেমন কাম্য , পুরুষের কাছে যুদ্ধও তেমনি কাম্য।
(ঘ) বিরোধীদের কণ্ঠরোধ :
একনায়কতন্ত্রে সকল রকম বিরোধিতার অবসানের জন্য ন্যায়-অন্যায় সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড, গুপ্তহত্যা প্রভৃতি পথে রাষ্ট্রনায়ক যাবতীয় বিরোধী সমালোচনার কণ্ঠরোধ করার ব্যবস্থা করেন।
বিরোধী ও বিদ্রোহী নেতাদের কারারুদ্ধ, মৃত্যুদণ্ড বা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্নও করে দেওয়া হয় ।
(ঙ) একদল একনেতা :
এই শাসনব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। কোন বিরােধী দলের অস্তিত্ব এখানে সহ্য করা হয় না। আর এই একটিদলের একজন নেতা থাকেন। তার নির্দেশিত পথেই সবাইকে চলতে হয়। তার বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা কারাে নেই।
(চ) ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ :
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একনায়কতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নির্বাহী বিভাগ একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এবং সাংবিধানিক কোন বাধানিষেধ একনায়কতন্ত্রে সহ্য করা হয় না।
(ছ) স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা :
স্বৈরাচারীতা এই শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বৈরাচারী শাসককে আড়ালে রেখে একনায়কের জনকল্যাণকর ও গৌরবময় নেতৃত্বের কথা সর্বদা প্রচার করা হয়।
একনায়ক মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন ।
(জ) গুপ্তচর বাহিনীর উপস্থিতি :
একনায়কতান্ত্রিক সরকারের স্থায়িত্বের জন্য ব্যাপক গুপ্তচর বাহিনীর ব্যবস্থা থাকে। জনগণ ও দলের মধ্যে বিরোধিতা ও চক্রান্তের সংবাদ সংগ্রহই হল এই নিপুণ গুপ্তচর বাহিনীর কাজ।
এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে হিটলারের ‘গেস্টাপো’ (Gestapo) এবং মুসোলিনির ‘কালো কোর্তা’ (Black Shirt) বাহিনীর কথা বলা যায়।
(ঝ) প্রচার মাধ্যমের বাকরোধ :
প্রচার মাধ্যম গুলো একনায়কতান্ত্রিক সরকারের চরম নিয়ন্ত্রণে থাকে। এক নায়কের জয়গান ছাড়া সরকার বিরোধী কোন বক্তব্য প্রচার করার সুযোগ থাকে না।
(ঞ) জনগণের স্বাধীনতা হরণ :
একনায়কতান্ত্রিক সরকার জনগণকে স্বাধীন চিন্তাধারা প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে একক আদর্শবাদ গ্রহণে বাধ্য
করে।
এক নেতা, একজাতি, একদেশ শ্লোগান দেওয়া হয়। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র ইত্যাদি সকল
প্রচার মাধ্যমে অভিন্ন আদর্শবাদ প্রচার করা হয়।
(ট) বলপ্রয়ােগ :
একনায়কতন্ত্রে জনগণের মতামত বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে দমন করা হয়। বিরােধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ব্যবস্থায় সকল ক্ষেত্রেই দমননীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
(ঠ) সরকারের নীতি প্রণয়ন :
একনায়কতন্ত্রে সরকারী নীতি ও পরিকল্পনাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এই কারণে সরকার সহজেই তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারে।
(ড) রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক :
একনায়কতন্ত্রে সরকারের মূল ভিত্তি হল সামরিক শক্তি। ট্রট্স্কির মতে, রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক।একনায়কতন্ত্রের নায়ক সংবিধান-বিরোধী পথে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন এবং ক্ষমতাসীন থাকেন।
তবে তাঁর অস্তিত্বকে আইনসিদ্ধ প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সামরিক শক্তির তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে থাকেন।
(ঢ) রাষ্ট্র ও সরকারের অভিন্নতা :
একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে অভিন্ন মনে করা হয়। উভয়ের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য করা হয় না।
ইংল্যাণ্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের মধ্যে অনেকেই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না।
ফ্রান্সের বুরবোঁ বংশীয় রাজা চতুর্দশ লুই নিজেই বলতেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’।
(ণ) সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র :
একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তি জীবনের সমগ্র দিকের নিয়ন্তা হল সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র । রাষ্ট্র এখানে সর্বাত্মক এবং সর্বশক্তিমান ।
এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মুসোলিনীর মতানুসারে, সকলেই রাষ্ট্রের ভিতরে, কেউই রাষ্ট্রের বাইরে বা বিরুদ্ধে নয়।
মূল্যায়ন :
পরিশেষে বলা যায় , দেশের শাসনক্ষমতা যখন কোন একজন স্বৈরশাসনের হাতে থাকে তখন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। একনায়কতন্ত্রের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা থেকে বোঝা যায় যে এই শাসন জনগণের জন্য কাম্য নয়।
আরো পড়ুন – জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের কারণ আলোচনা করো