অশোকের ধম্ম নীতি আলোচনা কর

অশোকের ধম্ম নীতি আলোচনা কর – মৌর্য সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে ছিলেন শিবের উপাসক। পরে তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন ধম্মনীতি।

অশোকের ধম্ম নীতি আলোচনা কর :

অশোকের ধম্ম নীতি আলোচনা কর

আরো পড়ুন – বাংলা গদ্যসাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান

অশোকের ‘ধম্ম’-এর বিভিন্ন দিক ও ধর্মপ্রচারে অশোকের বিভিন্ন উদ্যোগ :

ভূমিকা :

হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের ভাবধারার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল অশোকের ধম্ম । অশোক সর্বপ্রথম মাস্কি লিপিতে এই ধম্ম সম্পর্কে উল্লেখ করেন । অশোকের ধম্মে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ এবং সদাচারের পরিচয় পাওয়া যায় ।

অশোকের ‘ধম্ম’-এর বিভিন্ন দিক :

(১) অশোকের ধম্মের প্রেক্ষাপট : 

কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা অশোকের মনজগতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ছিল বলে বহু ঐতিহাসিক মনে করেন।

যদিও অধ্যাপিকা রোমিলা থাপার তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “সমকালীন আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি অশোকের মনে নতুন ধর্মাদর্শের জন্ম দেয়”।

(২) ধম্মের ভিত্তি :

অশোকের ধম্মের মূল ভিত্তি ছিল অহিংসা। যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ, প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁর অহিংস আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়।

(৩) ধম্মের উদ্দেশ্য :

অশোক তাঁর ধম্মের প্রবর্তনের মাধ্যমে মনুষ্য জীবন ও সমাজ জীবন দুইই পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন । অশোক বিশ্বাস করতেন মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিক পারিবারিক জীবন উন্নত হলে , সমাজজীবনও উন্নত হবে ।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বসাধারণকে নিয়ে এক সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন গঠন করে ছিল অশোকের ধম্মের মূল উদ্দেশ্য ।

(৪) ধম্ম-র স্বরূপ বা প্রকৃতি : 

অশোকের ধম্ম নীতিতে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন নীতির মূল নীতিগুলি যেমন – অষ্টাঙ্গিক মার্গ, আর্য সত্য, নির্বাণ প্রভৃতির কোন উল্লেখ নেই।

তাঁর ধম্মনীতি ছিল নৈতিক ও সামাজিক আচারণ বিধির সমন্বয়। যাতে প্রাণীজগতের প্রতি করুণা প্রদর্শনের নীতি যুক্ত ছিল।

অশোকের ধম্মে রয়েছে সংযম, করুণা, চিত্তশুদ্ধি ও মানবিক ঔদার্য। রিস ডেভিস, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, রোমিলা থাপার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মনে করেন অশোকের ধম্ম বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনেকখানিই আলাদা।

(৫) অশোকের ধম্মের বিভিন্ন পালনীয় বিধি :

  • (ক) ব্যক্তি জীবনে : ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধির জন্য অশোকের ধম্মে [i] দয়াশীলতা, [ii] দানশীলতা, [iii] সততা, [iv] সুচিতা, [v] ভদ্রতা, [vi] সৎ কর্মে আত্মনিয়োগ, [vii] সংযম, [viii] কৃতজ্ঞতা— এই 8টি গুন অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে।
  • (খ) সমাজ জীবনে : সামাজিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় অশোকের ধম্মে বেশ কিছু সামাজিক বিধি পালনের কথা বলা হয়েছে। যেমন – প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা, প্রাণীর ক্ষতি না করা , বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন , বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন , গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ,স্বল্প ব্যয় ,স্বল্প সঞ্চয় প্রভৃতি।

ধর্মপ্রচারে অশোকের নানান উদ্যোগ : 

(১) বিহার যাত্রার পরিবর্তে ধর্ম যাত্রা : 

সম্রাট অশোক তাঁর রাজত্বের দশম বছর থেকে বিহার যাত্রা অর্থাৎ রাজকীয় শিকার যাত্রার পরিবর্তে ধর্মযাত্রা শুরু করার নীতি গ্রহণ করেন ।

এই ধর্ম যাত্রার অর্থ হল বুদ্ধদেবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো পরিভ্রমণ করা। ধর্মযাত্রার সময় তিনি ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের অর্থাৎ বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের দান ধ্যান করতেন ।

(২) ধম্ম লিপি খোদাই :

অশোক তাঁর প্রজাদের মনে ধর্মীয় ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলার জন্য ধম্ম লিপি খোদাই-এর ব্যবস্থা করেন।

তিনি জনপথ গুলির নিকটবর্তী স্থানে পাথরের স্তম্ভে বা পর্বতের গায়ে সহজ সরল ভাষায় নিজের ধর্মীয় উপদেশ গুলো খোদাই করান।অশোক কর্তৃক এই খোদিত লিপিগুলি ধম্মলিপি নামে পরিচিত ।

(৩) ধম্মমহামাত্র নামে কর্মচারী নিয়োগ :

বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সম্রাট অশোক ‘ধম্ম মহামাত্র’ নামে এক বিশেষ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করেন। এছাড়াও তিনি দূত, রাজুক, পুরুষ, প্রাদেশিক প্রমুখ রাজকর্মচারীদের ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেন।

(৪) ধর্মপ্রচারক নিয়োগ : 

সম্রাট অশোক গৌতম বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য স্বদেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ধর্ম প্রচারককে পাঠান।

যেমন – তিনি তাঁর পুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) মহেন্দ্র ও কন্যা (মতান্তরে ভগিনী) সংঘামিত্রাকে সিংহলে ধর্মদূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।

মজঝিমকে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে , মহারক্ষিতকে গ্রিক রাজ্যে , মহাদেবকে মহিশূরে , রক্ষিতকে বারাণসীতে ।

(৫) তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির আয়োজন :

অশোকের আমলে বৌদ্ধ ধর্মের মতবিরোধ গুলি দূর করার লক্ষ্যে সম্রাট অশোক রাজধানী পাটলীপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীত-এর আয়োজন করেন ২৫০ খ্রি:পূর্বাব্দে ।

মূল্যায়ন :

বস্তুত, যে-নৈতিক আচরণগুলির কথা অশোক প্রচার করেছিলেন সেগুলি খাঁটি বৌদ্ধ ধর্মের সারবস্তু নয়।

জে. এফ. ফ্লিট, আর. কে. মুখার্জী, দীনেশচন্দ্র সরকার সকলেই মনে করেন যে অশোকের প্রচারিত ধর্মমত ছিল বিভিন্ন নীতির সমন্বিত রূপ।

তা মোটেই নিটোল বৌদ্ধ ধর্ম নয়।এছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান ভিত্তি অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও নির্বাণ লাভ সম্পর্কেও অশোক তাঁর ধৰ্ম্মে কোনো কথা বলেননি।

আরো পড়ুন – চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

FAQs On – অশোকের ধম্ম নীতি আলোচনা কর

অশোকের ধম্ম বলতে কী বোঝো ।

মৌর্য সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে ছিলেন শিবের উপাসক। পরে তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন ধম্ম ।

অশোকের ধম্মের স্বৰূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো ।

অশোকের ধম্ম নীতিতে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন নীতির মূল নীতিগুলি যেমন – অষ্টাঙ্গিক মার্গ, আর্য সত্য, নির্বাণ প্রভৃতির কোন উল্লেখ নেই।
তাঁর ধম্মনীতি ছিল নৈতিক ও সামাজিক আচারণ বিধির সমন্বয়। যাতে প্রাণীজগতের প্রতি করুণা প্রদর্শনের নীতি যুক্ত ছিল।
অশোকের ধম্মে রয়েছে সংযম, করুণা, চিত্তশুদ্ধি ও মানবিক ঔদার্য।
রিস ডেভিস, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, রোমিলা থাপার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মনে করেন অশোকের ধম্ম বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনেকখানিই আলাদা।

মন্তব্য করুন