বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন নিয়ে ।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

আরো পড়ুন – ভারতের ঐতিহাসিক সন্ধি ও চুক্তির তালিকা

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন :

ভূমিকা :

ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশই ছিল নিম্নবর্ণের দলিত হিন্দু। এই সময় বাংলার দলিত হিন্দুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল ।

নমঃশুদ্ররা তাদের ধর্মগুরু শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে ।

নমঃশুদ্র আন্দোলনের বিস্তার :

নমঃশুদ্রদের আদি বাসস্থান ছিল পূর্ববাংলার খুলনা, যশােহর, ফরিদপুর,ঢাকা,ময়মনসিংহ ও বরিশাল – এই ছয়টি জেলায় ।

নমঃশুদ্র আন্দোলনের কারণ :

পূর্ববাংলার খুলনা, যশােহর, ফরিদপুর,ঢাকা,ময়মনসিংহ ও বরিশালে যে নমঃশুদ্র আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তার কারণগুলি ছিল নিম্নরূপ –

(১) অর্থনৈতিক কারণ : 

নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকা খুলনা, যশােহর, ফরিদপুর,ঢাকা,ময়মনসিংহ ও বরিশালে উচ্চবর্ণের হিন্দু ও সৈয়দ মুসলমানদের হাতে জমির ওপর একচেটিয়া অধিকার ছিল ।

অন্যদিকে নমঃশূদ্ররা ছিল প্রান্তিক কৃষিজীবী, ভূমিহীন কৃষক ও মজুর। এই পরিস্থিতিতেই নমঃশূদ্ররা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল। 

(২) সামাজিক বৈষম্য : 

তৎকালীন সমাজে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে সামাজিক দিক থেকে পতিত ও অচ্ছুত বলে মনে করা হত। দলিত হিন্দুদের কোনো আচার অনুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করত ।

(৩) ধর্মপ্রচারকের ভূমিকা : 

ধর্মপ্রচারক প্রভু জগবন্ধু ও হরিচাদ ঠাকুর নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে উদার মানবতাবাদী ধর্মীয় ভাবধারাতে উদবুদ্ধ করেন।

শ্রীহরিচাদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মমর্যাদা সৃষ্টির জন্য তাঁর শিষ্যদের মতুয়া’ নামে অভিহিত করেন এবং তিনি ব্রাত্মণ জমিদার ও পুরােহিত শ্রেণির অবিচার ও শােষণের বিরুদ্ধে সােচ্চার হন।

আন্দোলনের পথে যাত্রা :

নমঃশূদ্র সম্প্রদায় নিজেদের আর্থসামাজিক দুরবস্থা দূর করার উদ্দেশ্যে সামাজিক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দেন হরিচাদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডল, মুকুন্দবিহারী মল্লিক, বিরাটচন্দ্র মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রমুখ নমঃশূদ্র নেতা।

নমঃশুদ্র আন্দোলনের সূচনা :

ফরিদপুর- বাখরগঞ্জ অঞ্চলে ১৮৭২খ্রিস্টাব্দে একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্র আন্দোলনের মূলত সূচনা হয়।

এখানে এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র নেতার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের লোকজন আসতে অস্বীকার করে। এরপর নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের সঙ্গ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে।

তারা উঁচু জাতের কৃষিকাজ, ঘর ছাওয়া বা অন্যান্য কাজ করতে অস্বীকার করলে প্রত্যক্ষভাবে নমঃশুদ্র আন্দোলনের সূচনা হয় ।

মতুয়া মহাসংঘের প্রভাব :

উনিশ শতকের শেষদিকে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয় মতুয়া মহাসংঘ ।

এই মতুয়া মহাসংঘ তার সহজ সরল ভক্তিবাদী মত প্রচার করে বাংলার নমঃশুদ্র সমাজের এক বিরাট অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের ধর্মীয়,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পরিপুষ্ট করে ।

বেঙ্গল নমঃশুদ্র আসোসিয়েশন গঠন :

হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত মতুয়া সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে নমঃশুদ্রদের সামাজিক আন্দোলন শুরু হয় ।তাদের আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রাম ।

নমঃশুদ্ররা এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯০২ খ্রি: একটি সমিতি গঠন করে । তাছাড়া যাত্রানুষ্ঠান ও প্রতি পরিবার থেকে ‘মুষ্টি’ সংগ্রহের মাধ্যমেও আন্দোলনের বিস্তার ঘটে ।

নমঃশুদ্ররা ১৯১২ খ্রি: বেঙ্গল নমঃশুদ্র এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে পুরোপুরি সংঘটিত হয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে ।

পরে এই আন্দোলন দলিত নেতা আম্বেদকরের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় ।

চণ্ডাল নামের পরিবর্তে নমঃশুদ্র নামের অনুমোদনের জন্য আন্দোলন :

নমঃশুদ্ররা তাদের অসম্মানজনক চণ্ডাল নামের পরিবর্তে নতুন নমঃশুদ্র নামের অনুমোদন চেয়েছিল ।

১৯১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় এই দাবি স্বীকৃত হয় । পরবর্তীকালে বাংলার নমঃশূদ্রদের নিয়ে ভিন্ন মাত্রার রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।

এর পাশাপাশি নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি যেমন – নিজেদের ব্রাত্মণ বলে দাবি, উপবীত ধারণ, এগারাে দিন অশৌচ পালন, পরিবারের মহিলাদের বাজারে যাওয়া বন্ধ করা অনুসরণ করে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়। 

সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব দাবি :

মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের প্রস্তাব ঘােষিত হলে নমঃশূদ্ররা ১৯১৭ ও ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে দুটি সম্মেলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের দাবি জানায়।

এর ফলে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় অনুন্নত শ্রেণির একজন প্রতিনিধি মনােনয়নের নীতি মেনে নেওয়া হয়। 

ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নমঃশুদ্রদের আস্থা :

নমঃশুদ্ররা তাদের রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খা পূরণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে । তারা ১৯৩২ খ্রি: সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতিকে স্বাগত জানিয়েছিল ।

কিন্তু ডঃ বি আর আম্বেদকর যখন বাধ্য হয়ে গান্ধীজির সঙ্গে পুনা চুক্তি স্বাক্ষর করেন তখন তাঁরা এর বিরোধিতা করেছিল ।

নমঃশুদ্রদের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা :

১৯৩৭ খ্রি: পর্যন্ত নমঃশুদ্ররা কংগ্রেসের সাথে তাদের দূরত্ব বজায় রেখেছিল । কিন্তু ১৯৩৮ খ্রি: ১৩ ই মার্চ কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু এলবার্ট হলের এক সভায় গুরুচাঁদ ঠাকুরকে অতিমানব বলে অভিহিত করেন ।

এই অভিবাদনের তিন দিন পর প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর ,যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল প্রমুখ নেতারা কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতা করার নীতি নেন ।

তাঁরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন ।

মূল্যায়ন :

নমঃশূদ্রদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে বাংলার দলিতরা বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার লাভ করতে সক্ষম হয়।

তবে দেশভাগের সময় নমঃশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল নমঃশূদ্রদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার আবেদন জানালেও শ্রীশ্রীহরিচাদ ঠাকুরের উত্তরসুরি প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের নেতৃত্বে নমঃশূদ্রদের একটি বড়ো অংশ মাতৃভূমি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করে।

আরো পড়ুন – ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন তালিকা

মন্তব্য করুন