বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলােচনা করাে

বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলােচনা করাে – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম ২০২৪ মাধ্যমিকের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি

বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলােচনা করাে :

বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলােচনা করাে

আরো পড়ুন – ডান্ডি অভিযান কী আলোচনা করো

বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি বা চরিত্র :

ভূমিকা :

পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে উনিশ শতকে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এক যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আলোড়নের সূচনা হয়।

তৎকালীন ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন ,রাজনীতি -জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ইতালিয় নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করে অনেক ঐতিহাসিক বাংলার এই জাগরণকে‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বা ‘Bengal Renaissance’ বলে অভিহিত করেছেন । 

রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ ছিলেন সেই নবজাগরণের ধারক ও বাহক।

নবজাগরণের উন্মেষ :

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, ধর্মীয় উদারতা, সমাজসংস্কার, আধুনিক সাহিত্যের বিকাশ প্রভৃতি শুরু হয়।

ফলে ঊনবিংশ শতকে বাংলার সমাজ সংস্কৃতিতেও ব্যাপক অগ্রগতি নবজাগরণ ঘটে।

নবজাগরণের প্রসার :

উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতা থেকে এই নবজাগরণের ধারা পরবর্তীকালে বাংলা তথা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন , দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।

উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি বা চরিত্র :

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে কেউ কেউ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের ইতালীয় নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন।এর ফলে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন –

(ক) শহরকেন্দ্রিক নবজাগরণ :

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। এই নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতার বাইরে অন্যান্য জায়গায় এই নবজাগরণ ছড়িয়ে পড়েনি। তাই গ্রামবাংলার গরিষ্ঠ অংশ এই নবজাগরণের ছোঁয়া পায়নি। বলা যায়, গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র শ্রেণির সঙ্গে এই নবজাগরণের কোনাে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

(খ) প্রকৃত নবজাগরণ :

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে স্যার যদুনাথ সরকার তার হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল গ্রন্থে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন । কারণ এই সময় বাংলার শিল্প সাহিত্য কলা-জ্ঞান, বিজ্ঞান প্রকৃতির এক অদ্ভুত পূর্ব উন্নতি হয়েছিল ।

(গ) হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধতা :

এই নবজাগরণের শরিক ছিল কেবল উচ্চবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায় । এই নবজাগরণে মুসলমান সম্প্রদায়ের কোন সম্পর্ক ছিল না ।

(ঘ) ব্রিটিশ নির্ভরতা :

বাংলার এই জাগরণ অতিমাত্রায় ব্রিটিশ-নির্ভর হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনের দ্বারাই ভারতীয় সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে।

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন, ‘ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড়ো উপহার হল আমাদের উনিশ শতকের নবজাগরণ। এই কারণে তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠাকে ‘গৌরবময় ভোর’ বলে অভিহিত করেছেন।

(ঙ) মৌলিকত্বের অভাব :

বাংলায় নবজাগরণের মৌলিকত্বের অভাব ছিল। একদিকে বেদ উপনিষদের প্রভাব, অপরদিকে পাশ্চাত্য উদারপন্থা ও হিতবাদের অনুপ্রেরণা।

মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির মতাদর্শ এক মিশ্র চিন্তাধারার জন্ম দেয়।

এর কুপ্রভাব হিসেবে তারা ইংরেজি গানের সুরের ঢঙে হিন্দুস্থানি গানের চর্চা করতেন এবং ইংরেজ কায়দায় খানাপিনা করতেন ও বিলাস বৈভবে কাটাতেন।

এদের অনেকেই দেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালেও ইল্যান্ড থেকে আমদানি করা বিলাসপণ্য ঘরে সাজিয়ে রেখে গর্ব অনুভব করতেন।

(চ) হিন্দু জাগরণবাদ :

বাংলার নবজাগরণ প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাগরণবাদে পর্যবসিত হয়। রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের কার্যকলাপে হিন্দু জাগরণবাদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর হিন্দুশাস্ত্রকে ভিত্তি করেই সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন।

তাই অনেকে মনে করেন, উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ।

(ছ) এলিটিস্ট আন্দোলন :

ডাঃ অনিল শীল এই নবজাগরণকে একটি এলিটিস্ট আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন । কারণ তার মতে উনিশ শতকে বাংলার এই নবজাগরণ কেবল কলকাতার উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । সাধারণের মধ্যে এর প্রভাব ছিটে ফোটাও পড়েনি ।

(জ) সাধারণ মানুষের ভিত্তিহীন যোগসূত্র :

বাংলার এই নবজাগরণের সঙ্গে গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার দরিদ্র মেহনতি মানুষের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মনে করেন যে, ঔপনিবেশিক শাসনের জ্ঞানদীপ্তি শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওপরই প্রতিফলিত হয়েছিল। সাধারণ জনগণের মধ্যে এর বিশেষ প্রভাব পড়েনি।

গুরুত্ব :

উনিশ শতকে নবজাগরণের ফলে, ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভারতীয়দের কাছে এর আগে এই ধারণা স্পষ্ট ছিল না। নবজাগরণের ফলেই ভারতীয় সামাজ মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পদার্পণ করে।এর ফলেই জন্ম নেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, যা ভারতীয় ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে।

মূল্যায়ন :

পরাধীন দেশে ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে বঙ্গীয় নবজাগরণ পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে নি ।তবুও এর গতিশীলতা, সৃজনশীলতা ও প্রাণশক্তিকে কোনওভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।

আরো পড়ুন – ডান্ডি অভিযান কী আলোচনা করো

FAQs On – বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলোচনা করো

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ বলতে কী বোঝায়?

পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে উনিশ শতকে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এক যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আলোড়নের সূচনা হয়।তৎকালীন ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন ,রাজনীতি -জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ইতালিয় নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করে অনেক ঐতিহাসিক বাংলার এই জাগরণকে‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বা ‘Bengal Renaissance’ বলে অভিহিত করেছেন । 

রেনেসাঁ বা নবজাগরণ প্রথম কোথায় ঘটে?

রেনেসাঁ বা নবজাগরণ প্রথম ঘটে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ।

কোন সময়ে বাংলায় নবজাগরণ ঘটে?

উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ ঘটে ।

বাংলার নবজাগরণ ছিল কোন শহরকেন্দ্রীক?

বাংলার নবজাগরণ ছিল কলকাতা শহরকেন্দ্রীক ।

বাংলার নবজাগরণে কোন কোন প্রতিষ্ঠান ভূমিকা ছিল ?

এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল (১৭৮৪), শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০), ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭), কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ (১৮৩৫), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর (১৮৫৭) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান।

মন্তব্য করুন