বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল – বাংলার নবাব মিরকাশিম,অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলা এবং মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোটের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজবাহিনীর বক্সারের প্রান্তরে যে যুদ্ধ বাঁধে তা বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

এই পৃষ্ঠায়

বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল :

বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

আরো পড়ুন – নৌবিদ্রোহের কারণ আলোচনা করো 

ভূমিকা :

বাংলার নবাব মিরকাশিম,অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলা এবং মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোটের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজবাহিনীর বক্সারের প্রান্তরে যে যুদ্ধ বাঁধে তা বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বক্সারের যুদ্ধের কারণ :

বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বক্সারের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ।বক্সারের যুদ্ধের প্রকৃত কারণসমূহ হল নিম্নরূপ –

রাজনৈতিক কারণ :

(ক) মিরকাশিমের স্বাধীনচেতা মনােভাব :

১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফরকে বাংলার মসনদচ্যুত করে এবং ইংরেজদের অধীনস্থ হয়ে সিংহাসনে আরােহণ করেও মীরকাশিম ছিলেন স্বাধীনচেতা। তিনি ইংরেজ কোম্পানির দেওয়া সব ঋণ পরিশােধ করে তাদের প্রভুর আসন থেকে সরিয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীতে পরিণত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এতে ইংরেজদের সাথে তার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।মিরকাশিমের এই স্বাধীনচেতা মনোভাব বক্সারের যুদ্ধ সংঘটনের পিছনে অনেকটাই দায়ী ছিল ।

(খ) রাজধানী স্থানান্তর :

বাংলার রাজধানী মুরশিদাবাদ কলকাতার খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায়, ইংরেজরা নবাবের কাজে প্রায় সময় হস্তক্ষেপ করত। মীরকাশিম ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত এবং স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার উদ্দেশ্যে তাঁর রাজধানী মুরশিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন। এতে ইংরেজরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়।

(গ) ফরমানের অবমাননা :

মির কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে অবৈধভাবে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। তিনি নিজেকে বৈধ নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার করে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের ফরমান নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা ইংরেজরা মেনে নিতে পারেনি।

সামরিক কারণ :

(ক) ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণ :

বাংলার নবাব মিরকাশিম এক প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। ইউরােপীয় রণকৌশল গ্রহণের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আফগান, তাতার পারসিক এবং আর্মেনীয়দের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর্মেনীয় গ্রেগরিকে তিনি তার প্রধান সেনাপতি ও ওলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করেন। ফরাসি সমরু ওয়াল্টার রাইন হাউন্ডকে ও আর্মেনীয় মার্কারকে তিনি অন্য সমর বিভাগের সেনাপতি নিযুক্ত করেন।

(খ) আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের কারখানা প্রতিষ্ঠা :

মিরকাশিম অনুভব করেছিলেন তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজন উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র ।তাই তিনি মুঙ্গেরে কামান,বন্দুক,গোলাবারুদের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন।মিরকাশিমের এই আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা নির্মাণ ইংরেজদের সহ্য হয়নি ।

অর্থনৈতিক কারণ :

(ক) আর্থিক সমস্যা :

  • [i] জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার দেড় আনা বাড়ান। 
  • [ii] ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন—এমন কর্মচারী ও জমিদারদেরও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদতপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের প্রাপ্য অর্থ পরিশােধ ও হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা করেন।
  • [iii] রাজস্ব আত্মসাৎকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ও কঠোর শাস্তি দেন।
  • [iv] আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ জোর করে আদায় করেন।
  • [v] জগৎশেঠ পরিবারের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করেন ।
  • [vi] চুক্তিমতো নবাব বর্ধমান,মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার রাজস্ব ইংরেজদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণমুক্ত হন ।

এর ফলে নবাবের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসলেও ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হয় ।

(খ) দেশীয় বণিকদের শুল্ক প্রত্যাহার :

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলায় বিনাশুল্কে ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকার বা সনদ লাভ করে। কিন্তু কোম্পানি ও তার কর্মচারিরা এটির চরম অপব্যবহার করে। ফলে, নবাব ও দেশীয় বণিকদের বিপুল পরিমাণ শুল্ক থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই তিনি ইংরেজদের বিনাশুল্কে বে-আইনি ব্যবসা নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেন। তিনি সব বণিকের পণ্যদ্রব্যের ওপর হতে শুল্ক প্রত্যাহার করে দেন। ফলস্বরুপ, বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া ও বিশেষ সুবিধা নষ্ট হয়ে যায়।

বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব বা ফলাফল :

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল ছিল সূদুর প্রসারী। এই যুদ্ধের পরে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরাট পরিবর্তন আসে।

(ক) ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ :

বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল যদি ইংরেজদের প্রতিকূলে যেত তাহলে ভারতের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে – “ এই যুদ্ধটি ছিল ভারতের ইতিহাসে সর্বাধিক নিষ্পত্তিমূলক নির্ণায়ক। ”

(খ) স্বাধীনচেতা নবাবের পতন :

 বক্সারের যুদ্ধে মীরকাশিমের পরাজয়ের ফলে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক নবাবের পতন হয়।

(গ) মীর জাফরের পুনঃসিংহাসন লাভ :

বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীরকাশিম সিংহাসনচ্যুত হলে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে মীরজাফর সিংহাসনে পুনঃ অধিষ্ঠিত হয়। এবার নবাবের সৈন্য সংখ্যা হ্রাস এবং নবাবের দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়।

(ঘ) আর্থিক লুণ্ঠনের সূচনা :

বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম-উদ-দৌলার কাছ থেকে পনেরাে লক্ষ টাকা উপঢৌকন হিসেবে আদায় করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলার কাছ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।

(ঙ) দেওয়ানি লাভ :

বক্সারের যুদ্ধের চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা , বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব দৃঢ় হয়েছিল , অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতা বহুগুণ বেড়েছিল।

(চ) উত্তর ভারতে আধিপত্যে বিস্তার :

বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর কোম্পানি বাংলার আধিপত্যকে দৃঢ় করে উত্তর ভারতের দিকে নজর দেয়। অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ্‌-দৌলা কোম্পানির অনুগত হন এবং নামসর্বস্ব মোগল বাদশা কোম্পানির দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে কোম্পানির আধিপত্যের সূচনা ঘটে ।

(ছ) স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত :

পলাশী যুদ্ধের চরম পরিণতি বক্সার যুদ্ধ। পলাশী যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা যে ক্ষমতা লাভ করেছিল তা পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত হয় বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে। এ যুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সূর্য দীর্ঘ দু’শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।

মূল্যায়ন :

পরিশেষে উল্লেখ্য, বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মঞ্চের প্রকৃত পরিচালক হয়ে ওঠে।ফলে বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল ।

আরো পড়ুন – পলাশীর যুদ্ধের কারণ আলোচনা করো

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

FAQs On – বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

বক্সারের যুদ্ধের সময় বাংলার নবাব কে ছিলেন ?

বক্সারের যুদ্ধের সময় বাংলার নবাব ছিলেন মিরকাশিম ।

বক্সারের যুদ্ধ কবে কাদের মধ্যে হয়েছিল ?

বক্সারের যুদ্ধ 1764 খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব মিরকাশিম,অযােধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলা এবং মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোটের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজবাহিনীর মধ্যে হয়েছিল ।

বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি কে ছিলেন ?

বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি ছিলেন হেক্টর মুনরো।

বক্সারের যুদ্ধে কে পরাজিত হয় ?

বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল 1764 খ্রিস্টাব্দে। এই যুদ্ধ বাংলার নবাব মিরকাশিম,অযােধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল শাসক দ্বিতীয় শাহ আলমের যৌথ বাহিনী এবং ব্রিটিশদের মধ্যে হয়েছিল। 22শে অক্টোবর, 1764 তারিখের বক্সারের যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল ।

বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল কোথায় ?

বক্সারের যুদ্ধ হয়েছিল বিহারের বক্সার নামক স্থানে ।

বক্সারের যুদ্ধ কত খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল ?

বক্সারের যুদ্ধ ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল ।

বক্সারের যুদ্ধের সময় অযোধ্যার নবাব কে ছিলেন ?

বক্সারের যুদ্ধের সময় অযোধ্যার নবাব ছিলেন সুজা-উদ-দৌলা ।

বক্সারের যুদ্ধের সময় বাংলার গভর্নর কে ছিলেন ?

বক্সারের যুদ্ধের সময় বাংলার গভর্নর ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ ।

বক্সারের যুদ্ধের সময় মুঘল সম্রাট কে ছিলেন ?

বক্সারের যুদ্ধের সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় শাহ আলম ।

মন্তব্য করুন