ক্রুসেডের কারণগুলি আলােচনা করাে – প্রাচ্যের মুসলিমধর্মাবলম্বী তুর্কি ও পশ্চিম ইউরােপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রায় দুশো বছর ধরে যে যুদ্ধ হয় তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই পৃষ্ঠায়
ক্রুসেডের কারণগুলি আলােচনা করাে :
আরো পড়ুন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
ভূমিকা :
খ্রিস্টধর্মের পবিত্র প্রতীক ক্লশ থেকেই ক্রুসেড নামের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রাচ্যের মুসলিমধর্মাবলম্বী তুর্কি ও পশ্চিম ইউরােপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রায় দুশো বছর ধরে যে যুদ্ধ হয় তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত।
ক্রুসেডের কারণসমূহ :
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত কারণ ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ –
[১] ধর্মীয় কারণ :
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত ধর্মীয় কারণগুলি ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ –
(ক) রােমান চার্চের হৃতগৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা :
১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক চার্চের সঙ্গে রােমান চার্চের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই পােপ দ্বিতীয় আরবান রােমান চার্চের হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডে আন্দোলনে জয়ী হলে খ্রিস্টানদের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অনেক সহজ হবে।
(খ) জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষা :
জিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র তীর্থস্থান। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেমের দখল নেয়। খ্রিস্টান যাজক, অভিজাত এবং রাজাগণ সংঘবদ্ধ হন ও সেলজুক তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেন।
আবার অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম ছিল হজরত মহম্মদ , হজরত মুসা ও হজরত দাউদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্রভূমি। তাই মুসলিমরাও জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষায় উদ্যত হলে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
[২] রাজনৈতিক কারণ :
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত রাজনৈতিক কারণগুলি ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ –
(ক) ইসলামের গতি রােধ :
হজরত ওমরের আমল থেকে, রাজ্যবিজয় ও ধর্মপ্রচারের মধ্যে দিয়ে ইসলামের সম্প্রসারণ শুরু হয়। রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মিশর, সিরিয়া, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ইটালি, সিসিলি-সহ সমগ্র পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। খ্রিস্টানরা ইসলাম সাম্রাজ্য বিস্তারের এই গতি রােধে সচেষ্ট হয়।
(খ) নিজ দক্ষতা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা :
অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়কালে ফ্রাঙ্করাজ চার্লস মাটেল আরবদের আক্রমণ রােধের লক্ষ্যে এক সুনিপুণ যােদ্ধাবাহিনী গড়ে তােলেন। খ্রিস্টধর্মের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একটা সুযোগ পাওয়ার জন্য তারা ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচনায় সাহায্য করে।
[৩] অর্থনৈতিক কারণ :
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত অর্থনৈতিক কারণগুলি ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ –
(ক) সামন্তপ্রথার প্রবর্তন :
একাদশ শতকে ইউরোপের সামন্তপ্রভুরা প্রাচ্যে ভূখণ্ড দখল করে সামন্তপ্রথার বিস্তারে উদ্যোগী হন। তারা সেখানে সামন্তপ্রথা প্রবর্তন ও পরাজিতদের শােষণের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্রুসেডে যােগ দেন।
(খ) অভিজাতদের লােভ :
যে সমস্ত অভিজাতর ম্যানরের আয় কমে গিয়েছিল, তারা এবং লােভী অভিজাতরা লুঠতরাজের মাধ্যমে ধন উপার্জনের লক্ষ্যে ধর্মযুদ্ধে যােগ দিয়েছিল।
(গ) বাণিজ্যিক স্বার্থ :
পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান বণিকগণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরিস্থিতি বদলায়।
নর্ম্যানরা মুসলমানদের কাছ থেকে সিসিলি কেড়ে নেয় এবং খ্রিস্টান শক্তি স্পেন অধিকার করে। ইটালির বণিকরা প্রাচ্য দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তােলে।
এই বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপােড়েনে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
[৪] সামাজিক কারণ :
(ক) ভূমিদাসদের মুক্তির আকাক্ষা :
ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করলে ভূমিদাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার ও ঋণগ্রহণকারীদের সুদের হার কমানাের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
তাই ক্রুসেডে যােগ দিয়ে ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল হাজার হাজার সার্ফ বা ভূমিদাস।
(খ) জনসংখ্যার আধিক্য :
মধ্যযুগে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে জমির পরিমাণ বাড়েনি। ফলে জমির ওপর নির্ভরশীলদের একাংশ নতুন ভূখণ্ডে শান্তিতে বসবাসের লক্ষ্যে ক্রুসেডের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করে।
(গ) তীর্থযাত্রীদের ক্ষোভ :
একাদশ শতকে জেরুজালেম সেলজুক তুর্কিদের অধিকৃত হওয়ার পরও বহু খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী জেরুজালেম ভ্রমণে আসতে থাকেন।
তীর্থযাত্রাকালীন তাদের অনেকেই দস্যুদের কবলে পড়েন ও আক্রান্ত হন। ফলে খ্রিস্টানগণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে দারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ক্রুসেডের ফলাফল :
ক্রুসেডের ফলাফল গুলি হল নিম্নরূপ –
(১) সামন্তপ্রথার ভাঙ্গন সৃষ্টি :
ক্রুসেডের ফলে সামন্তপ্রথার ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। বহু জমিদার ক্রুসেডের অর্থ সংগ্রহের জন্য তাদের জমি এমনকি শহরগুলোর স্বত্ব বিক্রি করে দেয়। ফলে সমগ্র ইউরোপে সামন্ত প্রভু শ্রেণি ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
(২) পোপের ক্ষমতা লোপ :
ক্রুসেডের ফলে ইউরোপবাসীর ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়। পোপ ও তার সহযোগীদের কার্যকলাপ নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। ফলে সমগ্র ইউরোপ পোপের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে।
(৩) বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন :
ক্রুসেডের ফলে ইউরোপবাসী মুসলমানদের নিকট থেকে মেরিনার্স কম্পাসের ব্যবহার সুগন্ধিদ্রব্য, মসলা, উন্নতমানের কৃষি পদ্ধতি ও শিল্পজাত দ্রব্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে এবং স্বদেশে ফিরে তারা প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
(৪) সংস্কৃতির সাথে পরিচয় :
ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যে সামরিক সংঘর্ষ হয় তার মাধ্যমে ইউরোপের দেশসমূহ প্রাচ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। তার প্রাচ্যের বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচয় লাভ করে।
(৫) রেনেসাঁর সূত্রপাত :
ক্রুসেডের ফলে ইউরোপে রেনেসাঁ সংঘটিত হয়। টয়েনবি বলেন, “ক্রুসেডের ফলে আধুনিক ইউরোপের জন্ম হয়।” মুসলমানদের উন্নত ভাবধারার সাথে পরিচয় না হলে ইউরোপে নব যুগের সূচনা হতো কিনা সন্দেহ।
মূল্যায়ন :
পরিশেষে বলা যায়, ক্রুসেডের ফলাফল ছিল ইউরোপ ও আফ্রিকার জন্য সুদূরপ্রসারী। এটি নিছকই কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল না। এর পিছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক পটভূমি জড়িত ছিল। এই ক্রুসেডের ফলেই মুসলমানদের শক্তি সম্পর্কে খ্রিস্টানগণ সম্যক ধারণা লাভ করে এবং ক্রুসেডের পথ ধরেই পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালিতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ ঘটে ।
আরো পড়ুন – জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের কারণ
FAQs On – ক্রুসেডের কারণগুলি আলােচনা করাে
প্রাচ্যের মুসলিমধর্মাবলম্বী তুর্কি ও পশ্চিম ইউরােপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রায় দুশো বছর ধরে যে যুদ্ধ হয় তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত।