চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও – চিনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে যে আমলাতান্ত্রিক গােষ্ঠী প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকত, তাদের বলা হত ম্যান্ডারিন।

চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও :

চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

আরো পড়ুন – ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা ও উপদেশ প্রদানের বিষয়টি কীভাবে জড়িত

ভূমিকা :

চিনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে যে আমলাতান্ত্রিক গােষ্ঠী প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকত, তাদের বলা হত ম্যান্ডারিন। ‘ম্যান্ডারিন’ একটি মালয়’ শব্দ। এই শব্দটির অর্থ যে কোন স্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী । কিন্তু এখানে ম্যান্ডারিন বলতে চিনের উচ্চপদস্থ পন্ডিত কর্মচারীদের বলা হয়েছে। চিনে আঞ্চলিক শাসনের স্তম্ভ ছিল এই ম্যান্ডারিন শ্রেণি ।

ম্যান্ডারিনদের উত্থান :

তাং বংশের রাজত্বকালে চিনের পদস্থ সরকারি কর্মচারী কাঠামোয় নানা বিবর্তন ঘটে। তাং বংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রি.) রাজত্বকালে পূর্বের প্রচলিত নয়-স্তরীয় ব্যবস্থা বাতিল করে চিনে নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এই নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ম্যান্ডারিন পদটি যথার্থ রূপ লাভ করে।

ম্যান্ডারিনদের যোগ্যতা :

চিনা উচ্চপদস্থ আমলা অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের বেশ কিছু যােগ্যতার অধিকারী হতে হত।

  • প্রশাসনিক দক্ষতা: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীকে প্রশাসনের কাজ চালানাের মতাে দক্ষতা দেখাতে হত।
  • শিক্ষাদীক্ষা: ম্যান্ডারিন পদে নিয়ােগ করার সময় বংশমর্যাদা ও সম্পত্তির পরিবর্তে যােগ্যতা ও শিক্ষাদীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হত l 
  • রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা: প্রার্থী ইতিপূর্বে স্থানীয় বা প্রাদেশিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত থেকে কোনাে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন কি না তাও দেখা হত।
  • ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্যের ধারণা: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার ছিল।
  • অন্যান্য যােগ্যতা: যােগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় প্রার্থীকে পাস করতে হত। অন্যদিকে পাহারাদার, অপরাধী, জেল খাটা আসামি, শ্রমিক, অভিনেতা, সঙ্গীতজ্ঞ, ক্রীতদাস ও ভিক্ষুকরা ম্যান্ডারিন পদে নিয়ােগের পরীক্ষায় বসতে পারত না।

ম্যান্ডারিনদের নিয়ােগ ও পদচ্যুতি :

(ক) ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ :

ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীদের নিয়ােগ করার আগে যােগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা নেওয়া হত। এই পরীক্ষায় কনফুসীও আদর্শ, তাওবাদ, সাহিত্য, কাব্য, সাধারণজ্ঞান, রাজনীতি এবং ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রশ্ন রাখা হত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের প্রথমে স্থানীয়, প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিয়ােগ করা হত।

(খ) ম্যান্ডারিনদের পদচ্যুতি :

সাধারণত ম্যান্ডারিনদের একই জায়গায় দীর্ঘদিন না রেখে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে দেওয়া হত। ম্যান্ডারিনরা তাদের কাজে অবহেলা দেখালে বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে বা সাম্রাজ্য বিরােধী কাজে লিপ্ত হলে প্রমাণ সাপেক্ষে তারা সম্রাট কর্তৃক পদচ্যুত হতেন।

ম্যান্ডারিনদের মর্যাদা :

চিনের সমাজে উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনগণ যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষত চিনের কিং বংশের রাজাদের আমলে চিনের সমাজে রাজপরিবার ও প্রধানমন্ত্রীর পরেই মর্যাদা ভােগ করতেন।

ম্যান্ডারিনদের বেশভূষা :

(ক) উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনদের বেশভূষা :

উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনগণ মূল্যবান ধাতুর অলংকারযুক্ত ও রত্নখচিত পােশাক পরতেন। তারা দামি পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি মাথায় দিতেন।

(খ) মধ্য ও নিম্নস্তরের ম্যান্ডারিনদের বেশভূষা :

মধ্য ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনগণও যথেষ্ট ব্যয়বহুল জীবন যাপন করতেন। তারাও জমকালাে পােশাক পরতেন এবং প্রবাল, লাপিস- লাজুলি, সােনা, রুপা প্রভৃতি রত্নখচিত টুপি মাথায় দিতেন।

ম্যান্ডারিনদের কার্যাবলি :

চিনের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্যসচিবালয়ের অধীনে ম্যান্ডারিনদের একাধিক কাজ করতে হত। যেমন-

(ক) প্রশাসন পরিচালনায় সাহায্য: চিনের ম্যান্ডারিনরা প্রশাসনের উধর্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন।

(খ) রাজকার্যে সাহায্য: সর্বোচ্চ স্তরের ম্যান্ডারিনগণ যেহেতু চিনা সম্রাটের প্রধানমন্ত্রীর সমগােত্রীয় ছিলেন, তাই তারা প্রত্যক্ষভাবে রাজাকে সহায়তা করার সুযােগ পেতেন।

(গ) সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা: মধ্যে ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনগণ প্রদেশ বা স্থানীয় অঞ্চলগুলিতে শান্তিগৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ নিতেন।

(ঘ) অন্যান্য কাজ: ম্যান্ডারিনরা ব্যাবসা বানিজ্যে তদারকি করা, আর্থিক ক্ষেত্রে সচলতা রক্ষা করা, সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকটি দেখাশােনা করা প্রভৃতি কাজও করতেন।

ম্যান্ডারিন ব্যাবস্থার গুরুত্ব :

চিনের সুপ্রাচীন ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –

(ক) উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা :

ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার মাধ্যমে চিনে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা ছিল যথেষ্ট উন্নত।

(খ) যোগসূত্র রক্ষা :

ম্যান্ডারিনরা চিনের স্থানীয় শাসক ও রাজার মধ্যে যোগসূত্র রক্ষার কাজ করত। ফলে সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছিল।

(গ) অত্যধিক শ্রমদান :

ম্যান্ডারিনরা কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং দিনের বেশিরভাগ সময় কাজে নিযুক্ত থাকতেন। ফলে প্রশাসনে গতি এসেছিল বলে অনেকে মনে করেন।

(ঘ) বিভিন্ন ধরনের কার্য :

শাসন পরিচালনা করা ছাড়াও ম্যান্ডারিনরা দেশের নিরাপত্তা, ব্যাবসাবাণিজ্য প্রভৃতি বহুবিধ কাজ করতেন। ফলে প্রশাসনে উৎকর্ষ এসেছিল।

(ঙ) জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থান :

চিনের সমাজে ম্যান্ডারিনগণ বিশেষ সুবিধাভােগী এবং বিশিষ্ট সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই ম্যান্ডারিনদের থেকেই পরবর্তীকালে চিনে জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছিল।

মূল্যায়ন :

চীনে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও একথা ঠিক যে, 1729 খ্রিস্টাব্দে গ্র্যান্ড কাউন্সিল গঠিত হলে ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনেকখানি হ্রাস পায়। শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্য শিক্ষা ধারার চাপে চিনে 1905 খ্রিস্টাব্দে ম্যান্ডারিন নিয়ােগ সংক্রান্ত পরীক্ষার অবসান ঘটে এবং 1911 খ্রিস্টাব্দে কিং (চিং) বংশের পতনের পর চিনে সমগ্র ম্যান্ডারিন প্রথার অবসান ঘটে।

আরো পড়ুন – ক্রুসেডের কারণগুলি আলােচনা করাে

FAQs On – চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও

ম্যান্ডারিন কাদের বলা হত ?

চিনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে যে আমলাতান্ত্রিক গােষ্ঠী প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকত, তাদের বলা হত ম্যান্ডারিন।

চিনে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে কবে ?

চিনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসনকালে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে ।

মন্তব্য করুন