বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের বিবরণ দাও

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের বিবরণ দাও – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের বিবরণ দাও এই প্রশ্নটা নিয়ে ।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের বিবরণ দাও

আরো পড়ুন – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের বিবরণ দাও

ভূমিকা :

বিজ্ঞান শিক্ষার মতোই এদেশে কারিগরি শিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রেও ইংরেজদের ছিলো প্রবল অনীহা। কোম্পানির শাসনের সূচনায় এদেশে সরকারি অফিস ও প্রশাসন বিভাগে কাজ চালানোর জন্য ইংরেজি জানা কিছু কেরানির প্রয়োজন পড়েছিলো। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই এদেশে সাধারন শিক্ষা বা জেনারেল শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে।

কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা :

কিন্তু অচিরেই এদেশে সড়ক, সেতু, বন্দর নির্মান ও রেলপথ স্থাপনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ করিগরের অভাব অনুভূত হয়। পূর্ত বিভাগ স্থাপনের ফলে সরকারের স্বার্থেই কারিগরি শিক্ষার সূচনা ঘটে। যদিও তার পরিধি ছিলো খুবই সীমিত।

কোম্পানির শাসনকালে (১৭৭৩ -১৮৫৭) এদেশে মাত্র ৬টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উচ্চ কারিগরি শিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রে ১৮৪৭ খ্রিঃ রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ১৮৫৬ খ্রিঃ শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ দেশ তথা বিশ্বে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে।

ভারতীয়দের দাবি :

বিকল্প কর্মসংস্থান ও স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে ভারতীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই কারিগরি শিক্ষার প্রসারের বিষয়টিকে নিয়ে সোচ্চার হন। প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসু ১৮৮৬ সালে সর্বপ্রথম কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য একটি পৃথক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব দেন।

উনিশ শতকের শেষদিক থেকে জাতীয় কংগ্রেস ও দেশীয় সংবাদপত্র গুলি কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের দাবি তোলে। ১৯০৪ খ্রিঃ কলকাতায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে একটি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। এই অ্যাসোসিয়েশন স্কলারশিপ দিয়ে এদেশের ছাত্রদের কারিগরি শিক্ষা লাভের জন্য ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে পাঠায়।

প্রথম উদ্যোগ :

বাঙালির কারিগরি ইতিহাস ঘাঁটলে প্রথম যে নামটি আসে তিনি হলেন গোলকচন্দ্র। তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে আগত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আদলে প্রথম কারিগরি যন্ত্র তৈরি করেন।

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা নিজেদের সামরিক প্রয়োজনে এ দেশে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ শুরু করলে এই বিভাগে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার শিবচন্দ্র নন্দী।

মহেন্দ্রনাথ নন্দী কাপড় বোনার যন্ত্র প্রস্তুত করেন। অচিরেই বাঙালি কারিগররা আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তিবিদ্যা শেখার দিকে মন দেয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ :

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন পর্বে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ৯২ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, রাজা সুবোধ মল্লিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। 

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য :

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল–

  • [1] স্বদেশি ধাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা,
  • [2] বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো ইত্যাদি।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান :

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে দুটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যথা–

  • [1] বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট কলকাতার বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এখানে কলা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। এর উদ্যোগে অনেক জায়গায় স্কুল খোলা হয়।
  • [2] বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI): ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট বা BTI প্রতিষ্ঠিত হয়।

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট :

BTI-এর পাঠ্যক্রম :

BTI-এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রমথনাথ বসু। এতে প্রথমদিকে দু-ধরনের পাঠ্যক্রম চালু করা হয়। একটি তিন বছরের অপরটি চার বছরের পাঠ্যক্রম।

এখানে যেসকল বিষয়ে পাঠ দেওয়া হত তা হল- i যন্ত্রবিজ্ঞান ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিজ্ঞান, ⅱ ফলিত রসায়ন ও iii ভূবিদ্যা। তবে পাঠ্যক্রমের প্রথমপর্বে পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজি ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত।

BTI-এর অগ্রগতি :

এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন প্রমথ দত্ত, শরৎ বসু, প্রফুল্ল মিত্র, ভূপাল ঘোষ প্রমুখ প্রখ্যাত শিক্ষকগণ।

এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তারকনাথ পালিত মহাশয়ের। জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রযুক্তিবিদ্যাকে সময়োপযোগী ও আধুনিক করে তোলার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল।

এই উদ্দেশ্যেই BTI-এর কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্র বিদেশে গিয়ে হাভার্ড, ইয়েল, মিচিগান ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।

এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এখান থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়।

ছাত্রসংখ্যাবৃদ্ধি :

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে BTI-এর ছাত্রসংখ্যা ছিল ১২৪ জন. ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয়েছিল ৫২০ জন।

কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (CET) প্রতিষ্ঠা :

দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’ ও ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ’ একত্রে মিশে যায়। এর নতুন নাম হয় ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড টেকনিকাল স্কুল’। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ বা CET ।এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উদ্যোগ গুলি হল –

জ্ঞানচর্চার শাখা :

CET-এ কলাবিভাগের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়।

জার্নাল প্রকাশ :

CET এর ছাত্রছাত্রীরা ‘টেক’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এই জার্নালের প্রথম সংখ্যাটি তাঁরা স্বদেশি আন্দোলনের যুগের সেই সকল আত্মত্যাগীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন যাঁরা জাতীয় শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা :

বাংলার সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। কলেজটি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে শিবপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং নতুন নাম হয় ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।

মূল্যায়ন :

বাংলায় কারিগরি শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে। বাংলা তথা ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। যদিও সমকালে অনেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে মিস্তিরি তৈরির কারখানা বলে উপহাস করেছেন।

আরো পড়ুন –একা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি

মন্তব্য করুন