ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা

ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করব ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে।

ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা

ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী ও সীমাবদ্ধতা

আরো পড়ুন –ফরাসি বিপ্লবের কারণ

ভূমিকা :

১৭৮৯ খ্রি: ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করলেও তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিদের মাথাপিছু ভোটদানের দাবি না মানলে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিরা নিজেদের সভাকে জাতীয় সভা বলে ঘোষণা করে এবং ১৭৮৯ খ্রি: ২০ শে জুন টেনিস কোর্টের মাঠে শপথ গ্রহণ করে । এই শপথ গ্রহণ করে তারা নতুন সংবিধান রচনার অঙ্গীকার করে । এই অবস্থায় সম্রাট ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণীর দাবি মেনে নিয়ে তিন শ্রেণীর যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন। এর ফলে জাতীয় সভা সংবিধান সভায় পরিণত হয় ।

সংবিধান রচনা:

১৭৮৯ -১৭৯১ এই দুই বছরের প্রচেষ্টায় ফরাসি সংবিধান সভা ফ্রান্সে একটি নতুন সংবিধান রচনা করে । এই সংবিধানই ছিল ফ্রান্সের প্রথম লিখিত সংবিধান । এই সংবিধান রচনার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা হলেন -লাফায়েৎ,মিরাবো,ট্যালিরান্ট ,রোবস্পিয়ার প্রমুখ প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ ।

ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলী:

ফরাসি সংবিধান সভা ফ্রান্সে নতুন সংবিধান রচনার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যাবলী সম্পাদন করেছিল । সেগুলি নিম্নে আলোচিত হল –

(ক) সামন্তপ্রথার বিলোপসাধন :

ফরাসি সংবিধান সভা ১৭৮৯ খ্রি: ৪ ঠা আগস্ট এক ঘোষণার মাধ্যমে ফ্রান্সের ‘সামন্তপ্রথার বিলোপসাধন ‘ করে । শুধুমাত্র যে সামন্তপ্রথার বিলোপসাধন করেছিল তা কিন্তু নয়,সামন্তপ্রথার পাশাপাশি সামন্ত কর, বেগার শ্রম প্রভৃতির ও বিলোপ সাধন করতে সমর্থ হয়েছিল ।

(খ) ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণা :

১৭৮৯ খ্রি: ৪ঠা আগস্ট সামন্ত প্রথার বিলোপ সাধনের পর ২৬ শে আগস্ট ফরাসি সংবিধান সভা ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ‘ ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় বলা হয় যে, স্বাধীনভাবে বাঁচা মানুষের জন্মগত অধিকার , আইনের চোখে সবাই সমান ইত্যাদি । ঐতিহাসিক ওলার এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, এই ঘোষণা পত্রটি ছিল ‘পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা।’

(গ) শাসনতান্ত্রিক সংস্কার :

শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সংবিধান সভা যেসব সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল –

  • ফ্রান্সের রাজার ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করা হয়।
  • শাসনবিভাগ ,আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগকে পৃথক করা হয়।
  • সমগ্র ফ্রান্সকে ১৮ টি বিভাগ বা ডিপার্টমেন্টে বিভক্ত করা হয়।
  • প্রতিটি প্রদেশকে আবার জেলা,ক্যান্টন ও কমিউনে ভাগ করা হয়।

(ঘ) অর্থনৈতিক সংস্কার :

শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের পাশাপাশি ফরাসি সংবিধান সভা কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনও করেছিল । সেগুলি নিম্নে আলোচিত হল –

  • ফ্রান্সের গির্জাগুলির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় ।
  • সমস্ত ফ্রান্স জুড়ে একই ওজন ,মাপ ও শুল্ক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ।
  • ফ্রান্সে আসাইনেট নামক একধরণের কাগজি মুদ্রার প্রচলন করা হয় ।

(ঙ) বিচার বিভাগীয় সংস্কার :

বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও ফরাসি সংবিধান সভা বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছিল সেগুলি হলো নিম্নরূপ –

  • আইনের চোখে সবাই সমান এই নীতি চালু করা হয় ।
  • নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের অধিকার স্বীকৃত হয় ।
  • নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি চালু করা হয় ।
  • এছাড়াও বিচারপতিদের নিয়মিত বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় ।

(চ) ধর্মীয় সংস্কার :

ফরাসি সংবিধান সভা ধর্মীয় ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার করেছিল –

  • ফ্রান্সের গির্জা গ্যালিকান গির্জা নামে পরিচিত হয় ।
  • আইনের মাধ্যমে গির্জাকে রাষ্ট্রের অধীনে আনা হয় ।
  • যাজক ও বিশপদের নির্বাচনের অধিকার সাধারণ জনগণের হাতে দেওয়া হয় ।
  • বিচারপতিদের মতো যাজক ও বিশপদেরও বেতন ব্যবস্থা করা হয় ।

ফরাসি সংবিধান সভার সীমাবদ্ধতা :

ফরাসি সংবিধান সভা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও সামন্তপ্রথার বিলোপ সাধন করে ব্যক্তি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় । সেগুলি হল নিম্নরূপ –

(ক) গণতন্ত্রের বিরোধী :

ফরাসি সংবিধান সভা ফরাসি নাগরিকদের দুভাগে বিভক্ত করার মাধ্যমে একমাত্র সম্পত্তিবান নাগরিকদেরই ভোটাধিকার প্রদান করেছিল। যা ছিল সম্পূর্ণ গণতন্ত্র বিরোধী।

(খ) অযোগ্য প্রশাসন :

নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক শাসক,জুরি,বিচারক প্রমুখের নিয়োগ করা হলে অযোগ্য ব্যক্তিত্বের হাতে প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থা অর্পিত হয় । এর ফলে শাসনব্যবস্থায় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ।

(গ) আইনসভার দায়িত্বহীন ক্ষমতা :

ফরাসি সংবিধান সভা কর্তৃক যে সংবিধান রচিত হয় সেখানে রাজা পেয়েছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর আইনসভা পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা । এর ফলে প্রশাসন ও আইনসভার মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ।

(ঘ) আসাইনেট নামক কাগজী মুদ্রার প্রচলন :

ফরাসি সংবিধান সভা চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আসাইনেট নামক এক ধরণের কাগজী মুদ্রার প্রচলন করলে বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বিপ্লবের পথ থেকে সরে দাঁড়ান ।

(ঙ) আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি :

সমগ্র ফ্রান্সকে কতকগুলি জেলা , প্রদেশ ও কমিউনে বিভক্ত করার ফলে ফ্রান্সে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয় ।

(চ) অবহেলিত তৃতীয় সম্প্রদায় :

ফরাসি সংবিধান সভা দারিদ্র কৃষক , শ্রমিক , দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষদের অবস্থার উন্নতির জন্য তেমন কোনো সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে সামর্থ হয়নি ।

মূল্যায়ন :

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে ফরাসি সংবিধান সভা ফরাসি জনগণের স্বার্থে বেশ কিছু সুপরিকল্পিত সংস্কার সাধন করলেও একেবারে তাদের সমস্ত দাবিদাওয়া মেটাতে সক্ষম হয়নি ।

আরো পড়ুন – ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি

মন্তব্য করুন