হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও – হরপ্পা সভ্যতা ভারতবর্ষের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পাবাসী এক উন্নত নাগরিক পরিবেশে আধুনিক জীবন যাপন করত।
এই পৃষ্ঠায়
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও :
আরো পড়ুন – চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও
ভূমিকা :
হরপ্পা সভ্যতা ছিল ভারতবর্ষের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পাবাসী এক উন্নত নাগরিক পরিবেশে আধুনিক জীবন যাপন করত। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান ও লােথাল প্রভৃতি প্রতিটি কেন্দ্রেই উন্নত নাগরিক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার চিত্রটি সহজেই অনুমান করা যায়।
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা :
(১) আঞ্চলিক বিভাজন :
হরপ্পা নগরটির দুটি অংশ ছিল একটি পশ্চিমের উঁচু দুর্গাঞ্চল, অপরটি পূর্বের নিম্নাঞ্চল।
- (ক) দূর্গ অঞ্চল : হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলির উঁচু স্থানে একটি দুর্গ থাকত। অনুমান করা হয় এই দুর্গে শাসকশ্রেণির মানুষ বসবাস করত। দুর্গটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত।
- (খ) নিম্নাঞ্চল : আর নিম্নাঞ্চলে সাধারণ শ্রেণির মানুষ বসবাস করত।
(২) রাস্তাঘাট :
চওড়া প্রশস্ত, সােজা এবং পরিচ্ছন্ন রাজপথ হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রধান রাস্তাগুলি 9 ফুট থেকে 40 ফুট চওড়া, পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল।
একটি রাস্তা অপর রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হত। রাস্তার দু-ধারে আলােকস্তম্ভ, বাঁধানাে ফুটপাথ ও ডাস্টবিন ছিল। পাথর, চুন-সুরকি দিয়ে রাস্তাগুলি তৈরি করা হয়েছিল।
(৩) ঘরবাড়ি :
হরপ্পা সভ্যতায় পোড়া ইটের তৈরি দোতলা- তিন তলা বড় বাড়ি যেমন ছিল, তেমনি মাঝারি ও ছোট আয়তনের বাড়িও ছিল।
অধিকাংশ বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে আগুনে পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে রোদে শুকানো ইটও ব্যবহার করা হতো।
প্রতিটি বাড়িতে রান্নাঘর, শোবার ঘর, স্নানঘর, উঠান, কুয়ো ইত্যাদি থাকতো।বাড়িতে প্রবেশের জন্য গলিপথ থাকতো। বাড়িগুলির রাস্তার দিকে কোনো জানালা দরজা থাকত না।
অধিকাংশ বাড়ি ছিল প্রাচীরবেষ্টিত। রাস্তার দুধারে রাস্তার পরিসর অনুসারে বাড়িগুলি তৈরি করা হতো। কোন বাড়ি রাস্তার উপর তৈরি করা হতো না।
(৪) পয়ঃপ্রণালী :
হরপ্পা সভ্যতার রাস্তাগুলির দু-ধারে বর্তমান কালের মতাে উন্নত পয়ঃপ্রণালী ছিল। বাড়ির নােংরা জল পয়ঃপ্রণালীর সাহায্যে বাইরে বেরিয়ে যেত।
পয়ঃপ্রণালীগুলির ওপরে পাথরের ঢাকনা বসানাে থাকত। নর্দমালিতে যাতে পলি পড়ে বা আর্বজনা পড়ে মজে না যায় তার জন্য ম্যানহােল দিয়ে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল।
ঐতিহাসিক এ. এল. বাসাম তার “The Wonder That Was India’গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, “রােমান সভ্যতার আগে অন্য কোনাে প্রাচীন সভ্যতায় এত সুদক্ষ পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা ছিল না।”
(৫) স্নানাগার :
মহেন-জো-দারাের দুর্গাঞ্চলে সর্বসাধারণের ব্যবহারযােগ্য এক বিশাল বাঁধানাে স্নানাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট ও প্রস্থ ১০৮ ফুট।
স্নানাগারটির চারিদিকে রয়েছে ৮ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল। ঋতুভেদে জল গরম অথবা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা ছিল।
কাছের এক কূপ থেকে স্নানাগারটিতে জল সরবরাহ এবং পয়ঃপ্রণালীর দ্বারা এখানকার ময়লা জল বের করার ব্যবস্থা ছিল। স্নানাগারটিতে নামা-ওঠার জন্য দুপাশে ইটের সিঁড়ি ছিল।
(৬) শস্যাগার :
হরপ্পা-সহ বেশ কয়েকটি শহরে শস্যাগারের নিদর্শন মিলেছে। হরপ্পার শস্যাগারটি ২০০ x ১৫০ বর্গফুট উঁচু একটি ভিত্তির ওপর অবস্থিত ছিল।
শস্যাগারটির পাশে শ্রমিকদের বস্তির মতাে ঘর ছিল। শস্যাগারটি হরপ্পা সভ্যতায় সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানার ইঙ্গিত বহন করে।
ঐতিহাসিক এ. এল. বাসাম এই শস্যাগারকে বর্তমান কালের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে আপৎকালীন সময়ের জন খাদ্যশস্য মজুত থাকত।
স্যার মর্টিমার হুইলার মনে করেন যে, পঞম শতকের আগে পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বড়াে শস্যাগারের নিদর্শন মেলেনি।
(৭) নির্মাণশৈলী :
হরপ্পার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং জলনিকাশি ব্যবস্থা সবকিছুতেই ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ, যা আধুনিক নগরের সঙ্গে তুলনীয় ।
নগরপুলিকে বিভিন্ন ধাপে একাধিকবার ভাঙাগড়ার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
(৮) পৌরব্যবস্থা :
নগরগুলিতে কেন্দ্রীভূত পৌরব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। নগরগুলির দেখাশােনার দায়িত্ব পালন করত পৌর প্রতিষ্ঠান। পৌর শাসনব্যবস্থার মান ছিল উন্নত।
অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী বলেছেন, “এখানে একই প্রকৃতির শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা ছিল যা জনগণের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করত৷”
(৯) জীবনযাত্রার সাদৃশ্য :
হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন নগরগুলিতে মানুষের জীবনযাত্রার ধরন তথা সমাজের সংস্কৃতি মোটামুটি একই রকম ছিল।
বিভিন্ন নগরের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকলেও নগরগুলির গঠন পরিকল্পনা তথা রাস্তাঘাটের নকশা, ঘরবাড়ির বিন্যাস, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি নজর, ওজোন ও মাপ ব্যবস্থা মোটামুটি একই রকম ছিল।
মূল্যায়ন :
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা আধুনিক যুগের মতােই উন্নত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। সুষ্ঠু নাগরিক পরিকল্পনা নগরবাসীকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রা উপহার দিয়েছিল। প্রাচীন যুগের এমন উন্নত নগর পরিকল্পনা শুধু প্রাচীন ভারত নয় সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নজির।
আরো পড়ুন – অশোকের ধম্ম নীতি আলোচনা কর
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog
পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63