ইতালির ঐক্য আন্দোলন টীকা – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম ইতালির ঐক্য আন্দোলন নিয়ে ।
আরো পড়ুন – এমস টেলিগ্রাম কি
এই পৃষ্ঠায়
ভূমিকা :
ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে ইতালি বিভিন্ন ছোট বড়ো রাজ্য নিয়ে গঠিত ছিল। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ছাড়া ইতালির সব রাজ্যই অস্ট্রিয়া-সহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তির অধীনস্থ ছিল। বিদেশি শক্তিগুলিতে বিতাড়িত করে বহুধা বিভক্ত ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে সমস্ত ব্যক্তি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কাউন্ট ক্যাভুর,জোসেফ ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডি।
জোসেফ ম্যাৎসিনির ভূমিকা :
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের অন্যতম একজন প্রাণ পুরুষ ছিলেন জোসেফ ম্যাৎসিনি। তিনি মনে করতেন যে, ইতালির অধিবাসীরাই ছত্রভঙ্গ ইতালির ঐক্য আনতে সক্ষম। এই কারণে তিনি ইতালির যুবশক্তিকে সুসংহত করতে সচেষ্ট ছিলেন।
(ক) ইয়ং ইতালি গঠন :
জোসেফ ম্যাৎসিনি ইতালির জনগণের মধ্যে নতুন জীবনী শক্তির সঞ্চার করার লক্ষ্যে ইয়ং ইতালি নামে একটি শক্তিশালী দল গঠন করেছিলেন,যে দলে ৩০ হাজার সদস্য ছিল।
(খ) স্বাধীনতা সংগ্রামী ম্যাৎসিনি :
ম্যাৎসিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে জেনোয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মূলত চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করলেও দার্শনিক এবং বাগ্মি হিসাবেও তিনি সুপরিচিত।
ইতালিকে মুক্ত করার কথা তিনি যৌবনকাল থেকেই ভেবেছেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের জন্য সেনাবাহিনীর মনে উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
(গ) ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এবং ম্যাৎসিনি :
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে এই প্রসঙ্গে অস্ট্রিয়ার প্রিন্স মেটারনিক বলেছিলেন যে, ফ্রান্সের সর্দি হলে সারা ইউরোপ হাঁচতে শুরু করে।
স্বাভাবিক ভাবেই ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফান্সের বিপ্লবের ঢেউ ইতালির ওপরও পড়ে। পিডমন্ট, মডেনা, পার্মা ইত্যাদি অঞ্চলে গণবিদ্রোহ শুরু হয়।
পিডমন্টের রাজা অ্যালবার্ট ছিলেন কিছুটা উদারপন্থী প্রকৃতির। এই সময় দিকে দিকে গণবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
(ঘ) নোভারার যুদ্ধ :
অস্ট্রিয়ার সেনাপতি রাডেটস্কীর কাছে পিডমন্টের রাজা চার্লস অ্যালবার্ট কাসটেজার-এর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন এবং ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত নোভারার যুদ্ধেও তিনি চরম ভাবে পরাজিত হন।
এই পরিস্থিতিতে তিনি তার পুত্র ভিক্টর ইম্যানুয়েলের অনুকূলে পিডমন্টের সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী মধ্য ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করে বিপ্লবকে দমন করতে সমর্থ হয়।
(ঙ) মিলানের বিদ্রোহ :
মিলানের যুদ্ধের সময়ও ম্যাৎসিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেননি। এই বিদ্রোহেও তাঁর অংশগ্রহণ চোখে পড়ে।
এই সময় মিলানের জনগণ চার্লস অ্যালবার্ট-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলে ম্যাৎসিনি কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েন। এরপর অ্যালবার্টের পতন হয় এবং ম্যাৎসিনি পুনরায় ঘুরে দাঁড়ান।
তিনি ঘোষণা করেন রাজাদের যুদ্ধের অবসান হয়েছে, এরপর প্রজাদের যুদ্ধ শুরু হবে। মূলত এই সময় থেকেই গ্যারিবল্ডি ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনিকে সাহায্য করেন।
(চ) রোমে প্রজাতন্ত্র স্থাপন ও পতন :
রোমে কিছুদিনের জন্য প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলেও পরে তার পতন হয়। ম্যাৎসিনি ছিলেন এই প্রজাতন্ত্রের অন্যতম শাসক।
তিনি নানাবিধ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা চালাতে থাকেন। রোমের এই প্রজাতন্ত্রী সরকারকে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রীরা একেবারেই ভালো চোখে দেখেননি।
এর ফলে ম্যাৎসিনির প্রজাতন্ত্রের সাথে রাজতন্ত্র ও ক্যাথলিক মতবাদের বিরোধ শুরু হয়। এরপর রোমের প্রজাতন্ত্রের পতন হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই লন্ডনে ম্যাৎসিনির মৃত্যু হয়।
(ছ) ম্যাৎসিনির কৃতিত্ব :
ম্যাৎসিনি তার লক্ষ্যে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি একথা ঠিক কিন্তু তার আদর্শ, দেশপ্রেম এবং ইতালির মুক্তি আন্দোলনের প্রচেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয়নি।
প্রজাতন্ত্রবাদী এবং মানবতার পূজারী হিসাবে ম্যাৎসিনি বিখ্যাত। ম্যাৎসিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইতালির ঐক্যসাধন ইতালির জনগণই সম্পন্ন করবে।
এই উদ্দেশ্যে তিনি ইতালির যুব সম্প্রদায়কে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার অভাব থাকায়, শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।
ম্যাৎসিনি তার লক্ষ্যে ব্যর্থ হলেও তিনি যে জাতীয় প্রেরনার পটভূমি রচনা করেছিলেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
কাউন্ট ক্যাভুরের ভূমিকা :
পিডমন্টের সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাউন্ট কাভুর এবং তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার আমলে পিডমন্ট অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছিল এবং তিনি ইতালির সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
(ক) ক্যাভুরের মতাদর্শ :
- (i) বিদেশি সাহায্য গ্রহণ : কাউন্ট ক্যাভুর ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া অস্ট্রিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিকে ইতালি থেকে বিতাড়িত করা যাবে না।
- (ii) স্যাভয় বংশের নেতৃত্ব : কাভুর পিডমেন্ট-সার্ডিনিয়ার স্যাভয় রাজবংশের অধীনে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
- (iii) পিডমেন্টের শক্তিবৃদ্ধি : কাউন্ট ক্যাভুর ইতালির ঐক্য সাধনের জন্য সর্বপ্রথম পিডমেন্টের শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।
(খ) বৈদেশিক নীতি :
- (i) ইঙ্গ-ফরাসি শক্তিকে সহায়তা ঃ ইতালির ঐক্য সাধনে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির সাহায্য গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ক্যাভুর ১৮১৫৫-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সহায়তা করেছিলেন।
- (ii) প্যারিসের বৈঠকে সুযোগ ঃ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ পরবর্তী প্যারিসের শান্তি বৈঠকে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইতালি তার অভিযোগগুলি উত্থাপনের সুযোগ পেয়েছিল।
- (iii) প্লোমবিয়ের্সের চুক্তি ঃ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ক্যাভুর ফ্রান্সের সঙ্গে প্লোমবিয়ের্সের গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
(গ) অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ :
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সঙ্গে গোপন সন্ধির পর ক্যাভুর অস্ট্রিয়াকে নানা ভাবে যুদ্ধের জন্য উস্কানি দিতে থাকে।
অবশেষে অস্ট্রিয়া ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ফ্রান্স পিডমন্টের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করে অস্ট্রিয়াকে ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে পরাজিত করে লম্বার্ডি দখল করে।
কিন্তু মাঝপথে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির দ্বারা পিডমন্টের সঙ্গে মিলান ও লম্বার্ডি যুক্ত হয়।
(ঘ) ক্যাভুরের ক্ষোভ ও পদত্যাগ :
ক্যাভুর ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধির বিরোধিতা করে। কিন্তু পিডমন্টের রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল উপলব্ধি করেন যে, ফ্রান্সের সহায়তা ছাড়া অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা অসম্ভব।
তাই তিনি যুদ্ধ বিরতিতে সম্মতি দিয়ে এই সন্ধি মেনে নেন। এরপর তিনি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জুরিখের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ক্যাভুর পদত্যাগ করেন।
গ্যারিবল্ডির ভূমিকা :
ইতালির এমন একটা সংকটময় সময়ে আগমন ঘটে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের অপর একজন প্রাণপুরুষ গ্যারিবল্ডি। গ্যারিবল্ডি ছিলেন একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক।
তিনি ছিলেন ইয়ং ইতালির সদস্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়েতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র সরকার গঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
(ক) সিসিলিতে কৃষক আন্দোলন :
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ইতালির সিসিলিতে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হলে গ্যারিবল্ডির কাছে সিসিলি ও নেপলসের অধিবাসীরা সাহায্য প্রার্থনা করেছিল।
গ্যারিবল্ডি গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে দক্ষ ছিলেন। তার সেনাবাহিনীকে ‘লাল কোর্তা’ বলা হত।
(খ) সিসিলি ও নেপলস অভিযান :
গ্যারিবল্ডি তার এক হাজার লাল কোর্তা বাহিনীর সাথে সিসিলি ও নেপলসে অবতরণ করেন। এই অঞ্চল দুটিকে তিনি অধিকার করে নেন এবং এর ফলে দক্ষিণ ইতালিতে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এরপর তিনি ইতালিতে পোপের রাজ্য আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
(গ) গ্যারিবল্ডির অবদান :
গ্যারিবল্ডি এবং ম্যাৎসিনি নীতির দিক থেকে অনেকটা কাছের লোক ছিলেন, কারণ উভয়েই ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক।
তিনি সিসিলি ও নেপলসকে ভিক্টর ইম্যানুয়েলের হাতে সমর্পণ করেন। এরফলে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে ইতালি রক্ষা পায়। এর ফলে তার উদারতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
মূল্যায়ন :
পরিশেষে বলা যায় যে, ম্যাৎসিনির আদর্শ ভিত্তিক প্রভাব, কাভুরের রাজনৈতিক কৌশল এবং গ্যারিবাল্ডির সামরিক অভিযানগুলি ইতালীয় একীকরণে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
আরো পড়ুন – হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog
জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK
পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63
আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
- জোলভেরাইন কি
- ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
- উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো
- ঘেটো কী
FAQs On ইতালির ঐক্য আন্দোলন টীকা
ইয়ং ইতালি গঠন করেন জোসেফ ম্যাৎসিনি ।
গ্যারিবল্ডি গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে দক্ষ ছিলেন। তার সেনাবাহিনীকে ‘লাল কোর্তা’ বলা হত।
ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি ১৮৫৯ সালে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়
প্লোমবিয়ের্সের চুক্তি ১৮৫৬ সালে ইতালির সঙ্গে ফ্রান্সের স্বাক্ষরিত হয় ।