জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ টপিক জালিয়ানওয়ালা হত্যাকান্ড নিয়ে ।
এই পৃষ্ঠায়
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব :
আরো পড়ুন – টীকা লেখো লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড :
ভূমিকা :
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইন পাস হলে সারা দেশে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর মধ্যে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি খুবই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
আর এর চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে।
জালিয়ানওয়ালাব্যাগ হত্যাকান্ড কি :
রাওলাট আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজীর আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশ জুড়ে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। 1919 খ্রিস্টাব্দের 13ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক স্থানে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী নিরস্ত্র জনতার উপরে গুলি চালালে সরকারি মতে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হয়।
যদিও বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। বর্বর ব্রিটিশ পুলিশের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট :
(ক) কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রণয়ন :
১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে শুধুমাত্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ রোধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রবর্তন করলে দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বলা যায় ১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ মাস থেকেই পাঞ্জাবের অবস্থা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
(খ) মাইকেল ও ডায়ারের অত্যাচারী শাসন :
অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন দমনমূলক পদক্ষেপ এর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলন ক্রমশ তীব্র হতে থাকে।
পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও ডায়ারের অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে বারুদের স্তূপে পরিণত করে ।
(গ) সইফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে গ্রেপ্তার :
রাওলাট আইনের প্রতিবাদের জন্য people’s committee নামক একটি সংগঠন লাহোর ও অমৃতসরে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
এই অবস্থায় সরকার ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল, অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপালকে হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
(ঘ) অমৃতসরে সামরিক আইন জারি :
পাঞ্জাবের অমৃতসরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসরের শাসনভার ন্যস্ত হয়।
এই বাহিনী 11 এপ্রিল একটি সামরিক আইন জারি করে শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা :
1919 খ্রিস্টাব্দের 13ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে প্রায় 10 হাজার জনতা সমবেত হয়েছিল দুই জনপ্রিয় নেতা সইফুদ্দিন কিচলু ও ডক্টর সত্যপালের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।
সভাস্থলটি চারদিকে ছিল বড় বড় পাকা বাড়ি এবং প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত। এই উদ্যানে প্রবেশের জন্য ছিল একটি পথ এবং প্রস্থানের জন্য ছিল চারটি সংকীর্ণ গলিপথ।
এই নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হওয়া নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা 11 ই এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি এবং জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধের কথা জানত না।
পাঞ্জাবি সামরিক শাসন কর্তা মাইকেল ও ডায়ার-এর বিশাল সেনাবাহিনী সেখানে উপস্থিত হন ।
এবং মাঠের ওই প্রবেশ পথ আটকে 50 টি রাইফেল থেকে জনগণকে কোন প্রকার সতর্কবার্তা না দিয়ে সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী 10 মিনিট ধরে প্রায় ষোলশ রাউন্ড গুলি চালায়। প্রচুর মানুষ হতাহত হয় সরকারি হিসাব অনুসারে নিহতের সংখ্যা ছিল 379 জন এবং আহতের সংখ্যা ছিল ১২০০ জন।
কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা 1 হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো ক্ষমা স্বীকার করা হয়নি ।
শুধু তাই নয় ওই দিন অমৃতসরের সান্ধ্য আইন জারি করে মৃতদেহগুলোকে তাদের আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া কিংবা আহতদের সেবা শুশ্রূষা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া :
জালিয়ানওয়ালাবাগের এই হত্যাকাণ্ড কে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপটি প্রকাশিত হয়। দেশে বিদেশে সর্বত্র সরকারের এই নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
(ক) ক্ষোভ প্রকাশ :
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড-এর প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র ঘৃণা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেছেন যে , এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছিল, তা উত্তর- দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।
(খ) উপাধি পরিত্যাগ :
কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার মাত্র প্রচন্ড রাগ আর ঘৃনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের “নাইট” উপাধি ত্যাগ করেন।
মাদ্রাজ হাইকোর্টের ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি সুব্রাক্ষনীয় আয়ার তার সরকারি “কে সি এস আই” খেতাব ত্যাগ করেন ।
এবং উদারপন্থী স্যার শঙ্করন নায়ার বড়োলাটের “একজিকিউটিভ কাউন্সিল” থেকে পদত্যাগ করে প্রতিবাদ জানান।
(গ) জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ :
জাতীয় কংগ্রেসও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে, কংগ্রেস নেতা C.F Andrus এই ঘটনাকে ‘কসাইখানার গণহত্যা’ বলে নিন্দা করেন।
গান্ধিজি young India পত্রিকায় লেখেন ‘এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব। একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে’।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব :
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগেরহত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না ।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বগুলি হল নিম্নরূপ –
(ক) ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন :
এই হত্যাকাণ্ড ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পশুসুলভ চরিত্রটি সমগ্র ভারতবাসীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে ইংরেজ সরকারের বর্বরতা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে।
(খ) অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত :
ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাবের সামরিক সরকার ও সামরিক কর্মচারীদের অপরাধ ছোট করে দেখাতে চাইলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গন আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।
তাই এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সুবিচারের দাবিতে গান্ধীজী ১৯২০ খ্রিঃ দেশব্যাপী অসহযোগ গন আন্দোলনের ডাক দেন ।
যা কিছুদিনের জন্য হলেও, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো।
মূল্যায়ন :
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ভারতীয় ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল। এতে ব্রিটিশ সরকারের নগ্নরূপটি ফুটে ওঠে।
এই ঘটনা ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে বিশেষ গতি প্রদান করতে সক্ষম হয়।
আরো পড়ুন – মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা টীকা লেখ
FAQs On – জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯ ,পাঞ্জাবের অমৃতসরে হয়েছিল ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক পঞ্জাবের লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ডায়ার।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেন ।
জালিয়ানওয়ালাব্যাগ শহরটি পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত ।
রাওলাট আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজীর আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশ জুড়ে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। 1919 খ্রিস্টাব্দের 13ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক স্থানে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী নিরস্ত্র জনতার উপরে গুলি চালালে সরকারি মতে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হয়।যদিও বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। বর্বর ব্রিটিশ পুলিশের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড চেমসফোর্ড ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হয় 1919 খ্রিস্টাব্দের 13ই এপ্রিল ।