উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি নিয়ে ।

উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

আরো পড়ুন – গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য

এই পৃষ্ঠায়

উদারনীতিবাদ বলতে কী বোঝো ? উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো :

ভূমিকাঃ

উদারনীতিবাদ বলতে এমন একটি মতবাদকে বোঝায় যেখানে সমাজের সকলের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরণের সংস্কার মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই মতবাদের প্রতিফলিত হয় ব্যক্তির চিন্তা, বিশ্বাস, মতপ্রকাশ প্রভৃতি। এই ব্যবস্থায় জনসাধারণের স্বাধীনতা ,ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং উদ্যোগে স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকে।

উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য :

উদারনৈতিক মতবাদের প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলি মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্য বা মূলসূত্র নিম্নে উল্লেখ করা হল –

(ক) জনগণের মঙ্গল সাধন : 

উদারনীতিবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হল জনগণের মঙ্গল সাধন করা। উদারনীতিবাদ নিয়ন্ত্রণহীন জনসম্মতির উপর কথা বলে। রাষ্ট্র যদি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয় তাহলে সেই রাষ্ট্র ব্যক্তিকে তার বিকাশের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাধা প্রদান করে না।

(খ) আইনগত পৌর স্বাধীনতা :

উদারনীতিবাদের প্রাথমিক দাবি হল প্রত্যেক ব্যক্তি নির্দিষ্ট আইন অনুসারে শাসিত হবে। ব্যক্তির পৌর অধিকার রক্ষার্থে আইন সবার উপরে স্থান দিতে হবে। আইনের নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য আবশ্যক।

(গ) রাজনৈতিক সাম্য এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রতিষ্ঠা :

রাজনৈতিক সাম্য বলতে রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সমানাধিকারকে বােঝায়। এই মতবাদ অনুসারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটদানের অধিকার থাকবে এবং রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণের সুযােগ সুবিধা থাকবে।

এর পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হল উদারনীতিবাদের আরও একটি উল্লেখযােগ্য লক্ষ্য বা নীতি। বেন্থাম মনে করেন যে, ব্যক্তির স্বার্থই হল প্রকৃত স্বার্থ। এই মতবাদ ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতার সম্প্রসারণ চায়।

(ঘ) জনসম্মতি :

রাষ্ট্রের সমস্তরকম ক্ষমতার উৎস হল জনসম্মতি। উদারনীতিবাদ মনে করে, ব্যক্তির শক্তিকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রশক্তি স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না। এইজন্য সর্বজনীন ভােটাধিকারের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

(ঙ)ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা : 

আধুনিক উদারনীতিবাদ ফ্যাসিবাদের তীব্র সমালোচনা করে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উদারনৈতিক রাষ্ট্রগুলি জার্মানির নাতসিবাদ ও ইটালির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিল।

(চ) পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি :

উদারনৈতিক মতবাদে জীবনের অধিকার, বাক ও মতামত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, ধর্মের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, নির্বাচনে ভােট দেওয়া ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার গুলিকে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

(ছ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা :

উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিক গােষ্ঠীর মতে, উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা সমাজ বিকাশের চাবিকাঠি।

অবাধ বাণিজ্য নীতি, সমস্তরকম শুল্ক ও বাধানিষেধের অবসান, চুক্তির স্বাধীনতা, ব্যাবসাবাণিজ্য সংগঠনের স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারে না।

বলাবাহুল্য, অ্যাডাম স্মিথ ও রিকার্ডো অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী উৎপাদন সংগঠনের স্বাধীনতা থাকবে।

(জ) সামাজিক স্বাধীনতা :

সামাজিক সম্পর্ক গত কৃত্রিম বৈষম্য দূর করার জন্য উদারনীতিবাদ সামাজিক স্বাধীনতার দাবি তােলে। অভিন্ন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে উদারনীতি বাদে সামাজিক সাম্য ও সামাজিক স্বাধীনতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এখানে স্ত্রী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেরই সমান স্বাধীনতার অধিকারকে বােঝানাে হয়।

(ঝ) ব্যক্তিগত স্বাধীনতা :

ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হল উদারনীতিবাদের মূলকথা। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে চিন্তার, মত প্রকাশের ও মুদ্রণের স্বাধীনতা, বিবেক বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা প্রভৃতিকে বাজানো হয়।

(ঞ) পারিবারিক স্বাধীনতা :

পারিবারিক স্বাধীনতা বলতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও মর্যাদা, পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি, শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রভৃতিকে বােঝায়। উদারনীতিবাদে এইরূপ পারিবারিক স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।

(ট) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা :

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নাগরিকের মৌলিক অধিকার গুলিকে সংরক্ষন করে থাকে। এছাড়াও বিচারব্যবস্থা এখানে সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও অভিভাবক রূপে কাজ করে থাকে।

উদারনৈতিক গণতন্ত্র সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, আইন ও সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য, শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরােপ করে।

(ঠ) সর্বজনীন ভােটাধিকারের স্বীকৃতি :

উদারনীতিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি বা বৈশিষ্ট্য হল সর্বজনীন ভােটাধিকারের স্বীকৃতি এবং একাধিক রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি।

সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ এবং একাধিক রাজনৈতিক দল থেকে পছন্দমতাে প্রার্থী বাছাইয়ের সুযােগ পাওয়া যায়।

এর ফলে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং গণ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদারনীতি বাদে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

(ড) জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি :

উদারনীতিবাদ জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী। স্লেসিংগার-এর মতে, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা প্রভৃতির ব্যবস্থা করে। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র শ্রমিক কল্যাণে আইন প্রণয়ন করতে পারবে।

(ঢ) একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব :

আধুনিক উদারনীতিবাদ জনগণের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার স্বার্থে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারিতাকে ব্যহত করার প্রচেষ্টায় এবং সামাজিক জটিল সমস্যাগুলিকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার অবাধ প্রয়াসে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বে আস্থাশীল।

(ণ) শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পরিবর্তন :

উদারনীতিবাদ বৈপ্লবিক ও হিংসাপূর্ণ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়। এই মতবাদীরা সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী অহিংস পদ্ধতিতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক সরকার পরিবর্তনে আস্থাশীল।

(ত) জনমত গঠন :

উদারনীতিবাদ সুষ্ঠূ ও সবল জনমত গঠনে সহায়ক। আর জনমত যদি সুষ্ঠূ না হয় তাহলে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটে।

(থ) বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা:

উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের বদলে বহুত্ববাদী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও গােষ্ঠী নিজেদের পারস্পরিক আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করার সুযােগ পায়।

(দ) বিশ্বায়নে বিশ্বাসী:

উদারনীতিবাদ সারা বিশ্ব জুড়ে পুঁজির অবাধ চলাচলে বিশ্বাসী। এরা মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী।

(ধ) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত:

উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে।

(ন) সংখ্যালঘু স্বার্থ রক্ষা:

উদারনীতিবাদ সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের উপর গুরুত্ব আরােপ করে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, পেশাগত প্রতিনিধিত্ব এবং মহিলা প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।

(প) জাতি-রাষ্ট্রের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি :

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। উদারনীতিবাদ সকলরকম আন্তর্জাতিক আগ্রাসনের বিরােধী মুক্তমনা এবং গতিশীল বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

(ফ) উদারনীতিবাদ বৈপ্লবিক উপায়ে শাসন ক্ষমতা পরিবর্তনের বিরোধী :

উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উপায়ে শাসনক্ষমতার পরিবর্তন চায় না, এই মতবাদ বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটের মাধ্যমে শাসনক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাসী।

সমালোচনা : 

উদারনীতিবাদ শুধু মার্কসবাদীদের দ্বারাই সমালোচিত হয়নি। অন্যান্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরাও এই মতবাদের সমালোচনা করেছেন।

প্রথমত, উদারনীতিবাদে অর্থনৈতিক সাম্য উপেক্ষিত হয়েছে। তাই অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। ’

দ্বিতীয়ত, উদারনীতিবাদে জনমত সঠিক ভাবে প্রকাশিত হয়নি। অধ্যাপক ল্যাস্কির ভাষায় , ‘যে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য থাকে না সেই সমাজে সুষ্ঠ জনমত তৈরি হতে পারে না। ’

তৃতীয়ত, মাকস্‌বাদীদের মতে উদারনীতিবাদে গণভোট, গনউদ্যোগে প্রভৃতির কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই প্রতিনিধি মূলক ব্যবস্থার কোনো মূল্যই থাকে না।

মূল্যায়নঃ       

উপরিউক্ত সমালোচনার সত্ত্বেও উদারনীতিবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সবশেষে বলা যায় যে, উদারনীতিবাদ রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণকে একসূত্রে আবদ্ধ রাখার একটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব। যেখানে সরকার সর্বদা জনগণের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। ফলে জনগণ তথা নাগরিক লাভ করবে ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, পারিবারিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্যের অধিকার প্রভৃতি। 

আরো পড়ুন – ক্ষমতার উপাদানগুলি আলোচনা করো

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

FAQs On উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

উদারনীতিবাদ বলতে কী বোঝো ।

উদারনীতিবাদ বলতে এমন একটি মতবাদকে বোঝায় যেখানে সমাজের সকলের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরণের সংস্কার মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই মতবাদের প্রতিফলিত হয় ব্যক্তির চিন্তা, বিশ্বাস, মতপ্রকাশ প্রভৃতি। এই ব্যবস্থায় জনসাধারণের স্বাধীনতা ,ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং উদ্যোগে স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকে।

আরো পড়ুন

মন্তব্য করুন