লতা মঙ্গেশকর প্রবন্ধ রচনা

লতা মঙ্গেশকর প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম লতা মঙ্গেশকর এই প্রবন্ধ রচনাটি নিয়ে ।

লতা মঙ্গেশকর প্রবন্ধ রচনা :

লতা মঙ্গেশকর প্রবন্ধ রচনা

আরো পড়ুন – বাংলার উৎসব প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা :

“আমাদের জীবনে আমাদের কখনোই হার মানলে হবে না, আমাদের অবিরাম কাজ করে যাওয়া উচিত, একদিন আমরা অবশ্যই সফলতা অর্জন করবো।” — লতা মঙ্গেশকর

সেই ধন্য নরকুলে যা শত বৎসর ধরে হৃদয়ের মনিকোঠায় জাগ্রত,সর্বদা কণ্ঠস্থ এবং মানুষের জীবনে অসংখ্য অমূল্য উপহার বহনকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার হলো সঙ্গীত।লতা মঙ্গেশকর, ওরফে ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ ছিলেন একজন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। 

মানুষ নিজের গলায় গান গেয়ে, সুমধুর কণ্ঠে গান শুনে এবং শুনিয়ে যে অনাবিল আনন্দ লাভ করে ইহলোকে তেমন আনন্দানুভূতির জুড়ি মেলা ভার। ভারতীয় উপমহাদেশও সেই সুপ্রাচীন যুগ থেকেই উচ্চমানের সংগীতের পীঠস্থান।

যুগে যুগে ভারতবর্ষের বুকে আবির্ভাব ঘটেছে অনন্য সব সঙ্গীত শিল্পীদের। তারা তাদের প্রতিভা দ্বারা শুধু ভারতেরই নয়, সমগ্র ভুলোকের সঙ্গীত জগৎকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন।

আধুনিক যুগে ভারতবর্ষের এমনই এক অনন্য সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন ভারতরত্ন প্রাপক শ্রীমতি লতা মঙ্গেশকর।একটা সময় পর্যন্ত সমগ্র বহির্বিশ্ব ভারতীয় সঙ্গীত জগতকে লতা মঙ্গেশকরের নামের সঙ্গে সমার্থক ভাবে চিনত।

তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে , ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় এবং বিদেশী ভাষায় মোট দশ হাজারেরও বেশি গানে কন্ঠ দিয়েছিলেন।

জন্ম ও বংশপরিচয় :

ইন্দোরের শাস্ত্রীয় গায়ক ও নাট্য শিল্পী পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর এবং শেবন্তীর কোল আলো করে ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন স্বনামধন্য গায়িকা লতা মঙ্গেশকর।

লতাজীরা মোট পাঁচ ভাইবোন।লতা ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ কন্যা। বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলে হলেন লতা মঙ্গেশকরের ছোট বোন।

এছাড়াও বিখ্যাত এই গায়িকার দুই বোন ও একটি ছোট ভাই রয়েছে। দুই বোনের নাম হল, ঊষা মঙ্গেশকর ও মিনা মঙ্গেশকর এবং ছোট ভাইয়ের নাম হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।

প্রাথমিক জীবন :

অনেক ছোট বয়স থেকেই স্বনামধন্য গায়িকা নিজের বাবার কাছেই গান শেখা শুরু করে দিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে গান গাওয়ার অনুমতি মিললেও সমস্ত গান শেখার অনুমতি মেলেনি তার।

গায়িকার বাবা চাইতেন মেয়ে শুধু ধ্রুপদী গান করুক। আর সেই জন্যই ছোট বেলায় কে এল সায়গল ছাড়া আর কোন গান গাওয়ার অনুমতি মেলেনি তার।

তবে লতার মাত্র ১৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পিতা দীনানাথ মঙ্গেশকরের মৃত্যু হলে তাদের পরিবারে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও অন্ধকার নেমে আসে।

তবে এতে লতার সঙ্গীত শিক্ষায় ছেদ পড়েনি। বরং এই সময়েই তিনি প্রথম পেশাদারী সংগীত জগতে পা রাখেন।

সঙ্গীত জীবন :

মারাঠি ছবি ‘জগভাউতে’ তিনি সর্বপ্রথম হিন্দি গানে কণ্ঠ দান করেন। এরপর লতা সুযোগ পান প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের ‘শহীদ’ ছবিতে গান গাওয়ার।

এবং এর অব্যবহিত পরেই ‘মজবুর’ সিনেমায় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘দিল মেরা তোড়া’ গানটি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তাকে আর পিছনে ঘুরে তাকাতে হয়নি।

পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পর পারিবারিক অভিভাবক মাস্টার বিনায়ক দামোদর কর্নাটকীর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর মুম্বাইতে চলে আসেন।

এখানে ওস্তাদ আমন আলী খাঁ এর কাছে ভিন্ডিবাজার সংগীত ঘরানার মাধ্যমে হিন্দুস্তানি সংগীতে লতার হাতেখড়ি হয়।

১৯৪৮ সালে অভিভাবক বিনায়ক দামোদর কর্নাটকীর মৃত্যু হলে গোলাম হায়দার লতার সংগীতজীবনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।

লতা মঙ্গেশকরের হাত ধরেই ভারতীয় ছায়াছবির গানের জগতে মাহফিল ঘরানার সংগীতের অবসান ঘটে এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রকৃতির ঘরানা উঠে আসে ।

তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু হিন্দি ছায়াছবির গান হলো: আয়েগা আনে ওয়ালা, সুন সাহেবা সুন, ইয়ারা সিলি সিলি, দিল হুম হুম করে, তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম ইত্যাদি। 

বাংলা গানে লতাজী :

হিন্দি ছায়াছবির গানের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন ভাষায় সমগ্র সঙ্গীতজীবনে লতা মঙ্গেশকর গান রেকর্ড করেছিলেন। এরমধ্যে কয়েকটি ভাষায় লতাজীর ব্যুৎপত্তি ছিল চোখে পড়ার মতো।

সেই ভাষা গুলির মধ্যে অন্যতম কিংবা বলা যায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষায় তিনি দুইশটিরও বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন।

এর কারণ হিসেবে সমসাময়িককালে হিন্দি ছায়াছবিতে বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক তথা গায়কদের একাধিপত্যকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়।

হিন্দি ছায়াছবির সংগীতে কাজ করার সময়ই লতার পরিচিতি ঘটে মান্না দে, কিশোর কুমার, শচীন দেব বর্মন প্রমূখ বাঙালি সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে।

তাদেরই হাত ধরে বাংলা ভাষার প্রতি লতার বিশেষ আগ্রহ জন্মায়। মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলাতেও তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন।

তার গাওয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু বাংলা গান হলো: প্রেম একবারই এসেছিল, সাত ভাই চম্পা, চঞ্চল মন আনমনা হয়, ও মোর ময়না গো, আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন, কেন কিছু কথা বলো না, যদিও রজনী পোহালো তবুও ইত্যাদি। 

খ্যাতির শীর্ষে লতা মঙ্গেশকর :

লতা মঙ্গেশকর তার জীবনে যে খ্যাতির চূড়ায় উঠতে পেরেছেন তা একদিনে সম্ভব হয়নি। প্রায় আট দশক তিনি ভারতীয় সঙ্গীত জগতের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে যুক্ত থেকেছেন।

দশকের পর দশক ধরে একটু একটু করে তার প্রতিভা যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমনি তিনি সমৃদ্ধ করেছেন ভারতীয় সংগীতকে।

একটা সময়ের পর ভারতবর্ষের বাইরে ভারতীয় ছায়াছবির মহিলা সংগীতশিল্পী হিসেবে লতা মঙ্গেশকর এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন দেশও তাকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানাতো।

প্রথম ভারতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে লতাই লন্ডনের রয়াল অ্যালবার্ট হলে নিজের সংগীতানুষ্ঠান করেছিলেন।

১৯৬৩ সালে ভারতের পার্লামেন্টে তার গাওয়া ‘এ মেরে বতন কে লোগো’ গানটি সমগ্র দেশে দেশাত্মবোধের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। 

পুরস্কারলাভ :

লতা মঙ্গেশকর তার কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন (২০০১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ (১৯৯৯), তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে (১৯৬৯) ভূষিত হয়েছেন।

এই সঙ্গীতশিল্পীকে ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘লিজিয়ন দ্য অনার’ খেতাব প্রদান করেছে।

এছাড়া তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭),এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯), এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন।

তিনি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

পরবর্তী কালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।

১৯৭৪ সালে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক গান রেকর্ড করার জন্য গিনেস বুক অফ রেকর্ডে তাঁর নাম ওঠে। তাঁকে ১৯৮০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার সুরিনামের সাম্মানিক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।

১৯৮৭ সালে আমেরিকার সাম্মানিক নাগরিকত্ব পান। ১৯৯০ সালে পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাম্মনিক ডক্টরেট প্রদান করা হয় ।

১৯৯৬ সালে ভিডিওকন স্ক্রিন লাইফটাইম পুরস্কার। ২০০০ সালে আই আই এফ লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার এরকম আরো বহু পুরস্কার ও সম্মানে তিনি ভূষিত।

লতাজীর প্রয়াণ :

2022 সালের 8 জানুয়ারি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভরতি হন লতা মঙ্গেশকর। করোনা মুক্তও হয়েছিলেন তিনি কিন্তু পরবর্তীকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে।

অবশেষে এই কোকিলাকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর 92 বছর বয়সে,ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ, সকাল 8 টা নাগাদ ওই হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

উপসংহার :

লতাজী মানুষের মনের মনিকোঠায় এমন এক জায়গায় অবস্থান করছেন যে তিনি আজ না থাকলেও তাঁর গানের মাধ্যমে, সৃষ্টির মাধ্যমে যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। এই শিল্পীর শিল্পসত্তা বেঁচে থাকবে আমাদের মনে, প্রাণে আজীবন ।

আরো পড়ুন – বিজ্ঞান ও কুসংস্কার প্রবন্ধ রচনা

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

FAQs On-লতা মঙ্গেশকর প্রবন্ধ রচনা

লতা মঙ্গেশকরের আসল নাম কি ?

লতা মঙ্গেশকরের আসল নাম হেমা মঙ্গেশকর ।

লতা মঙ্গেশকরের স্বামীর নাম কি ?

লতা মঙ্গেশকর কখনো বিবাহ করেননি ।

লতা মঙ্গেশকরের ভাইবোন কারা ?

লতাজীরা মোট পাঁচ ভাইবোন।লতা ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ কন্যা। বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলে হলেন লতা মঙ্গেশকরের ছোট বোন।এছাড়াও বিখ্যাত এই গায়িকার দুই বোন ও একটি ছোট ভাই রয়েছে। দুই বোনের নাম হল, ঊষা মঙ্গেশকর ও মিনা মঙ্গেশকর এবং ছোট ভাইয়ের নাম হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।

লতা মঙ্গেশকর কত সালে ভারতরত্ন পান ?

ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন ২০০১ লতা মঙ্গেশকর ।

লতা মঙ্গেশকর কত সালে জন্মগ্রহণ করেন ?

লতা মঙ্গেশকর ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন

লতা মঙ্গেশকরের পিত ও মাতার নাম কী ?

লতা মঙ্গেশকরের পিত হলেন ইন্দোরের শাস্ত্রীয় গায়ক ও নাট্য শিল্পী পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর এবং মাতা হলেন শেবন্তী ।

লতা মঙ্গেস্কর কবে মারা যান ?

কোকিলাকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর 92 বছর বয়সে,২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ, সকাল 8 টা নাগাদ ওই হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

লতা মঙ্গেস্কর পদ্মবিভূষণ পুরস্কার লাভ করেন কবে ?

লতা মঙ্গেস্কর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ ১৯৯৯ সালে লাভ করেন ।

 

মন্তব্য করুন