মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে – 1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তা ইতিহাসে মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত ।মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে ।
এই পৃষ্ঠায়
মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে :
আরো পড়ুন – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব কী
মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র :
ভূমিকা :
1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তা ইতিহাসে মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত ।মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে ।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে এটা নিছক সিপাহী বিদ্রোহ, কারও মতে এটা সামন্ত বিদ্রোহ, কেউ বলেছেন জাতীয় সংগ্রাম। কেউবা একে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।
নিছক সিপাহী বিদ্রোহ :
ঐতিহাসিক চার্লস রেকস , দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রি: বিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন ।
এই বক্তব্যের সপক্ষে ঐতিহাসিকদের যুক্তিগুলি হল নিম্নরূপ –
(ক) সিপাহীদের অসন্তোষ থেকেই মহাবিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল ।
(খ) এই বিদ্রোহের সূচনা ঘটে সেনাছাউনি থেকে ।
(গ) ঐতিহাসিকদের মত অনুসারে এই বিদ্রোহের সূচনা যেমন সেনাছাউনি থেকে হয়েছিল তেমনি বিদ্রোহী সিপাহীরাই ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ।
(ঘ) কোথাও কোথাও স্থানীয় মানুষ ,ভূস্বামী ও প্রাক্তন শাসকেরা সিপাহীদের সমর্থন জানালেও এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ছিল সিপাহীরাই ।
জাতীয় বিদ্রোহ :
অধ্যাপক সুশোভন সরকার, হোমস, আলেকজান্ডার ডাফ, শশীভূষণ চৌধুরী প্রমুখের মতে এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না। এটি ছিল একটি জাতীয় বিদ্রোহ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের টৌরি দলের সদস্য ডিজরেইলিও মহাবিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে মনে করেন । তাঁদের মতে –
(ক) তাদের মতে, মুজাফফরনগর, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে সিপাহিদের সংযোগ ছাড়াই অসামরিক লোকজন ও জমিদার শ্রেণির ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে।
(খ) সিপাহিরা সিংহাসনচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে দেশবাসীর মনে দেশপ্রেমের মনোভাব জেগে ওঠে।
(গ) তারা দেখিয়েছেন, দেশের উত্তর, মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম অংশে বিশেষত অযােধ্যা, দিল্লি, রােহিলখণ্ড প্রভৃতি অঞ্চলে এই বিদ্রোহ কার্যত গণসংগ্রামের রূপ নেয়।
(ঘ) ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, নানা সাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখ রাজন্যবর্গ, তালুকদার ও জমিদার এই বিদ্রোহে যোগ দেন ।
কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এই বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আখ্যা দিয়েছেন ।
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া :
ডঃ রজনীপাম দত্ত, আর. সি. মজুমদার প্রমুখ মার্কসবাদী ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহকে সামন্তশ্রেণীর বিদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেছেন । তাঁদের মতে –
(ক) নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, কুনওয়ার সিং প্রমূখ সামন্ত শ্রেণীর মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
(খ) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত শ্রেণি ও মৃতপ্রায় সামন্তশ্রেণির ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’।
(গ) আবার এরিখ স্টোক্স-এর বিচারে এই বিদ্রোহ ছিল একদল গ্রামীণ ভূস্বামীদের স্বার্থরক্ষার সংগঠিত প্রয়াস।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ :
দেশপ্রেমিক বিনায়ক দামোদর সাভারকর তার “ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইনডিপেনডেন্স” গ্রন্থে মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে গণ্য করেছেন। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, পি সি জোশী, অশোক মেহতা, অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার প্রমুখরাও ১৮৫৭ -র বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।তাঁদের মতে –
(ক) ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং নিজ নিজ রাজ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ও সর্বোপরি ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ করেছিলেন। যদিও এই মতকে বহু ঐতিহাসিকরা অস্বীকার করেছেন।
(খ) ১৮৫৭-র বিদ্রোহেই প্রথম জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে আপামর ভারতবাসী একই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে, একই শত্রুর মােকাবিলায় সামিল হয়েছিল। ভারত থেকে অত্যাচারী ইংরেজ শাসনের উৎপাটন ছিল তাদের সাধারণ লক্ষ্য।
কৃষক বিদ্রোহ :
ঐতিহাসিক খালদুনের মতে এই বিদ্রোহ ছিল কৃষক শ্রেণীর বিদ্রোহ । তাঁর মতে –
(ক) অগণিত কৃষকেরা এই বিদ্রোহে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে ছিল। সমকালীন অনেক ইংরেজ কর্মচারীও এই মতকে সমর্থন করেছেন।
মূল্যায়ন :
মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি কি ছিল তা এককথায় বলা বেশ কষ্টসাধ্য। এই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে যেসব মত উঠে আসে তার প্রত্যেকটির সুনির্দিষ্ট যুক্তি আছে। আবার এই সবের পাল্টা যুক্তিও আছে। তাই সম্পূর্ণভাবে এক কথায় ১৮৫৭ -র বিদ্রোহের প্রকৃতি বলা দুঃসাধ্য । বস্তুতপক্ষে ১৮৫৭-র বিদ্রোহ কোনাে ঐতিহাসিকের নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক বক্তব্য মেনে পরিচালিত হয়নি। গতির আবেগে বিদ্রোহ সমস্ত তত্ত্বকেই সংমিশ্রিত করেছিল।
আরো পড়ুন – একা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো
FAQs On – মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে
মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে ।
লখনৌতে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বেগম হজরত মহল ।
সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ মঙ্গল পান্ডে ।
মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন বাহাদুর শাহ ।