অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য

অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য – আজকের পর্বে আমরা তোমদের সাথে আলোচনা করলাম অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য ।

অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য

আরো পড়ুন – জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উপায়গুলি আলোচনা করো

পেশাদারী ইতিহাস : 

বর্তমানে ঐতিহাসিকদের অনেকেই ইতিহাসচর্চাকে তাদের পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং পূর্ণ সময়ের জন্য ইতিহাস চর্চায় নিয়োজিত থাকেন।

যেসব ঐতিহাসিকরা এই ইতিহাসচর্চাকে তাদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদেরকে পেশাদার ঐতিহাসিক বলা হয় এবং তাদের ইতিহাস চর্চাকে পেশাদারি ইতিহাস বলা হয় ।

মোটামুটিভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ইউরোপে এই ধরণের ইতিহাস চর্চা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ভন রাঙ্কে ইউরোপে আধুনিক তথ্যনির্ভর পেশাদারি ইতিহাসের অন্যতম পথিকৃৎ।

পেশাদারি ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য:

  • i) প্রাথমিক উপাদানের উপর নির্ভর করে যথেষ্ট যাচাই ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে পেশাদারি ইতিহাস লেখা হয়। তাই এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি।
  • ii) মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও ধর্মীয় জীবনসহ মানব সভ্যতার সমগ্র বিষয়ই পেশাদারি ইতিহাসের আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে।

অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য: 

পেশাদারী ইতিহাসের সঙ্গে অপেশাদারী ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য গুলি হল নিম্নরূপ —

(ক) উদ্ভবগত পার্থক্য : 

প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতকের শেষে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউরোপের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস চর্চার কাজ পেশাদারী ভিত্তিক হয়। সেই সময় থেকে কোন কোন ঐতিহাসিক ইতিহাস চর্চা বা ইতিহাসের গবেষণাকে পেশাদারী কাজ হিসেবে গ্রহণ করেন। যার ফলে নতুন দিক উন্মোচন হয়।

       অন্যদিকে,অপেশাদারি ইতিহাস চর্চা উনিশ শতকের অনেক আগেই অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে শুরু বলা যায়। তাই বলা যায় হেরোডোটাস, থুকিডিডিস যে ইতিহাস চর্চার সূচনা ঘটান তাতে পেশাদারি তত্ত্বের কোন ছাপ ছিল না।

(খ) অর্থনৈতিক সম্পর্কগত পার্থক্য : 

পেশাদারী ইতিহাস চর্চার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে। এই ইতিহাস চর্চার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি এই ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসবিদগণ ব্যক্তিগতভাবেও আর্থিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পান।

       অন্যদিকে, অপেশাদারি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সাধারণত সরকারি আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদ বা গবেষকগণ নিজের আর্থিক ব্যয়ে ইতিহাস চর্চা বা গবেষণা করেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সুবিধা লাভের তেমন কোনো সুযোগ নেই।

(গ) পদ্ধতিগত পার্থক্য : 

পেশাদারী ইতিহাসবিদগন তাদের গবেষণার কাজে খুব উন্নতমানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

    অন্যদিকে, অপেশাদারি ইতিহাস চর্চায় সাধারণত স্থানীয় তথ্যাদি,ক্ষেত্রসমীক্ষা প্রভৃতি পদ্ধতি ব্যবহার করে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

(ঘ) সময়গত পার্থক্য : 

পেশাদারী ইতিহাস হলো একটি দীর্ঘ সর্বক্ষণের কাজ। তাই গবেষকরা বা ইতিহাসবিদরা তাদের প্রধান পেশা হিসেবে ইতিহাস চর্চার কাজ করেন।

      অন্যদিকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপেশাদারি ইতিহাস চর্চায় গবেষকগণ তাদের ইতিহাস চর্চার কাজকে একটি আংশিক সময়ের কাজ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।

(ঙ) ব্যক্তিগত পার্থক্য : 

বর্তমানকালে অধিকাংশ বর্বর ধরনের পেক্ষাপটে ইতিহাস চর্চা পেশাদারী ইতিহাসবিদরা করেন। এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এই জাতি বা রাষ্ট্রের এমনকি সভ্যতার উত্থান পতন, সমাজব্যবস্থা,অর্থনীতি,রাজনীতি,ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করা হয়।

      অন্যদিকে, বর্তমানকালে অপেশাদারী ইতিহাস চর্চা তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেসব স্থানীয় ইতিহাস চর্চা হয় সেগুলি স্থানীয় ইতিহাসকে তুলে ধরে।

(চ) জীবিকাগত পার্থক্য : 

পেশাদারী ইতিহাসবিদের জীবন ও জীবিকা অনেকাংশে নির্ভরশীল হয় তাদের ইতিহাস চর্চার কাজের ওপর।

       অন্যদিকে, অপেশাদারী ইতিহাস বিদদের জীবন ও জীবিকা ইতিহাস চর্চার কাজের ওপর তেমন ভাবে নির্ভরশীল নয় বললেই চলে।

(ছ) ইতিহাস রচনার পদ্ধতি :

পেশাদারি ঐতিহাসিকেরা নিরপেক্ষতা ও নির্মোহতার সাথে কোনো ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষন করেন। বিভিন্ন সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রভৃতি উপাদান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পর সেগুলি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অধিক ফলনাত্বপূর্ণ তথ্যগুলির ওপর ভিত্তি করে উক্ত ঘটনার বিশ্লেষন ও লিপিবদ্ধ করেন।

অন্যদিকে, অপেশাদারি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাবাবেগ ও পক্ষপাতিত্ব করেন। ঐতিহাসিক কোনো ঘটনাকে আদর্শ অনুযায়ী সাধারনভাবে লিপিবদ্ধ করেন।

(জ) স্বাধীন চিন্তা: 

পেশাদারী ইতিহাস রচনার ঐতিহাসিকরা জ্ঞান ,যুক্তি ও চিন্তার দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা দান করেন।

অন্যদিকে, অপেশাদারী ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদদের সেই দায়বদ্ধতার অভাব থাকে।

(ঝ) আকর তথ্য সংগ্রহ: 

পেশাদারী শাখায় আকর তথ্য (Primary Source) এর উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ এই তথ্য দ্বারা ইতিহাসবিদগণ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করেন বা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন । এক্ষেত্রে তারা আকর তথ্যগুলি যাচাই করেন।

অন্যদিকে, অপেশাদারী শাখায় এই মনোভাবের অভাব দেখা দেয়।

(ঞ) মৌখিক ইতিহাস: 

পেশাদারি ইতিহাদ রচনার ক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনী, কিংবদন্তি, লোককথা, স্মৃতি কথা, ইত্যাদি এই ধরনের ঐতিহাসিক উপাদানের গুরুত্ব কম কারণ এতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব স্পষ্ট।

অন্যদিকে, অপেশাদারী ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে মৌখিক ইতিহাস বা জনশ্রুতির গুরুত্ব অপরিসীম।

মূল্যায়ন :

পরিশেষে বলা যায়,উভয় ইতিহাসের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয়ের উদ্দেশ্যই একটা যে অতীতের ঘটনাবলী গুলিকে যথেষ্ট তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে একটি ত্রুটিহীন ইতিহাসে পরিণত করা ।

আরো পড়ুন – ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি

মন্তব্য করুন