ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব কেন হয়েছিল

ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব কেন হয়েছিল – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব হওয়ার কারণ নিয়ে ।

ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব কেন হয়েছিল

ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব কেন হয়েছিল

আরো পড়ুন –রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি টীকা

ভূমিকা :

শিল্প বিপ্লব বলতে মূলত ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত সময়কালে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরকে বোঝায়। এই সময়কালে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। বিভিন্ন কারণে অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল । 

ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব হওয়ার কারণ :

ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। এই কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

(ক) কৃষি বিপ্লব :

অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

এর ফলে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও শ্রমিকদের জন্য সস্তায় খাদ্যের কোন অভাব হয় না। আর্থিক সচ্ছলতার ফলে কৃষকেরা শিল্পদ্রব্য ক্রয়ে সমর্থ হয়। এভাবে দেশের অভ্যন্তরে একটি বাজার গড়ে ওঠে।

(খ) উপযুক্ত কাঁচামালের যোগান :

শিল্প বিপ্লবের জন্য তিনটি প্রয়ােজনীয় উপাদান হল কাঁচামাল, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বাজার ও মূলধন। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে এর কোনটিরও অভাব হয়নি।

উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। এইসব অঞ্চল থেকে ইংল্যান্ড অবাধে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল সংগ্রহ করত।

(গ) বাজার :

ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্য ইংল্যান্ড নিজের দেশে বিক্রির পর তার উদ্বৃত্ত শিল্পপণ্য তার বিভিন্ন উপনিবেশের বাজারগুলিতে বিক্রির সুযোগ পেয়েছিল। এইসব স্থানে কার্যত একচেটিয়া বাণিজ্যের ফলে ইংরেজ বণিকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে।

(ঘ) মূলধনের জোগান :

ইংল্যান্ডের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আর্থিক ব্যবস্থা ছিল, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাঙ্ক এবং স্টক মার্কেট, যা নতুন যন্ত্রপাতি এবং শিল্প উদ্যোগে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি সংগ্রহ ও বরাদ্দের সুবিধা করেছিল।

১৬৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য স্থিতিশীলতা এবং সহায়তা প্রদান করে।

এছাড়া তারা ভারত ও চীন থেকে নানা বিলাস দ্রব্য আমদানি করে ইউরােপের বাজারে বিক্রি করত এবং প্রচুর মুনাফা লুঠত। পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রিঃ) পর বাংলার ধনভাণ্ডার ইংরেজ কোম্পানীর হাতে আসে। এইসব কারণে ইংরেজ বণিকদের কখনই মুলধনের কথা চিন্তা করতে হয়নি।

(ঙ) সস্তা শ্রমিক :

ষােড়শ শতক থেকে ইংল্যান্ডে কৃষিজমিকে পশুচারণ-ভূমিতে পরিণত করা শুরু হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ভূমিহীন বেকার কৃষক।

তারা শহরের কলকারখানাগুলিতে নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হতে থাকে। এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলেও শ্রমিকের যােগান সহজলভ্য হয়। এই সুলভ শ্রমিক শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হয়।

(চ) সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা :

১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে গৃহযুদ্ধের ফলে মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। তারা ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে নেতৃত্ব কায়েম করে এবং শিল্পবিপ্লবেও তাদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তারা পার্লামেন্টে সরকারকে শিল্পের উন্নয়নের জন্য সাহায্য করতে বাধ্য করে। ব্রিটিশ সরকারও দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নানাভাবে সাহায্য করে।

আমদানিকৃত বিদেশী পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করে।

(ছ) প্রাকৃতিক পরিবেশ :

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে কয়লা, লােহা, টিন ও তামা পাওয়া যেত। ইংল্যান্ডের স্যাতসেঁতে আবহাওয়া বস্ত্রশিল্পের উপযােগী ছিল।

প্রাকৃতিক বন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রচুর খাল ও খাড়ি থাকায় কাঁচামাল ও পণ্য চলাচল অনেক সুবিধাজনক হয় ।

(জ) বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার :

ইংল্যান্ডের অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বেশ কিছু যন্ত্রপাতির সময়ােপযােগী আবিষ্কার, যা শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পেই প্রথম যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয়।

  • ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন কে ‘উড়ন্ত মাকু’ বা ‘ফ্লাইং শাটল’ নামে কাপড় বােনার এক উন্নত মানের যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
  • ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে হারগ্রিভস্ আবিষ্কার করেন সুতাে কাটার উন্নত যন্ত্র ‘স্পিনিং জেনি’।
  • আর্করাইট আবিষ্কার করেন জলশক্তিচালিত কাপড় বােনার যন্ত্র ‘ওয়াটার ফ্রেম’ (১৭৬৯ খ্রিঃ)।
  • কার্টরাইট আবিষ্কার করেন ‘মিউল’ (১৭৮৫ খ্রিঃ) নামে কাপড় বােনার এক উন্নত ধরনের যন্ত্র।
  • এতদিন এই যন্ত্রগুলি জলশক্তি ও বায়ুশক্তির সাহায্যে চালানাে হত। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে জেমস্ ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেল। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে যন্ত্রগুলিকে ইচ্ছেমতাে চালানাে যায় এবং বড় বড় কারখানা চালু করা সম্ভব হয়।
  • ম্যাথু বােল্টন নামে এক ব্যক্তি জেমস্ ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে থাকেন। এর নাম ‘বােল্টন ইঞ্জিন’।
  • ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে জন স্মিটন কাঠকয়লার পরিবর্তে কয়লার সাহায্যে লােহা গলাবার চুল্লী বা ‘ব্লাস্ট ফার্নেস’ আবিষ্কার করেন।
  • খনিগর্ভে নিরাপদে কাজ করার জন্য হামফ্রি ডেভি আবিষ্কার করেন ‘সেফটি ল্যাম্প’ (১৮১৫ খ্রিঃ)। পরিবহনের ক্ষেত্রেও যুগান্তর আসে।
  • ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে টেলফোর্ড ও মাকডােম পাথরকুচি ও পিচ দিয়ে মজবুত রাজপথ তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেন।
  • ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে জর্জ স্টিভেনসন্ বাষ্পচালিত রেলইঞ্জিন তৈরি করেন।
  • ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ফুলটন তৈরি করেন বাষ্পীয় পােত বা স্টিমার। এইসব আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ড প্রথম শিল্প বিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়।

(ঝ) যোগাযোগ ও পরিবহন :

সমুদ্রবেষ্টিত ইংল্যান্ডের নৌশক্তি ছিল বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। পণ্যবোঝাই ব্রিটিশ জাহাজগুলি সমুদ্রপথে পৃথিবীর সব দেশে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। দেশের উপকূলে অবস্থিত অসংখ্য বন্দর থেকে খাল ও নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনের সুবিধা ছিল যথেষ্ট উন্নত। 

(ঞ) বাণিজ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি :

ইংল্যান্ড সপ্তদশ শতকের মধ্যেই কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে বাণিজ্যনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠায় তারা শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পায়।

মূল্যায়ন :

ইংল্যান্ডে শিল্পায়নের উপযোগী সব উপাদানই বিদ্যমান থাকায় সেদেশে শিল্পায়নের বিকাশ সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল। অন্যান্য দেশে দেখা যায় যে, একটি উপাদানের অস্তিত্ব থাকলেও অন্য একটি উপাদানের অস্তিত্ব না থাকায় তারা ইংল্যান্ডের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল।

আরো পড়ুন – হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি

মন্তব্য করুন