ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব

ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব নিয়ে ।

ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব

আরো পড়ুন –রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি টীকা

এই পৃষ্ঠায়

ভূমিকা :

ফ্রান্সে রােবসপিয়র-এর নেতৃত্বে জেকোবিন দল ১৭৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তা ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব বা সন্ত্রাসের শাসন (Reign of Terror) নামে পরিচিত। এই সন্ত্রাসের রাজত্ব ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত মােট ১৩ মাস ধরে চলেছিল।

পটভূমি :

(ক) ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন :

ঐতিহাসিক তেইন (Taine) বলেন যে, বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পরিবর্তে কিছু উগ্র, অসাধু ও ক্ষমতালোভী মানুষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। তারাই গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র-বিধ্বংসী সন্ত্রাসমূলক কাজে অবতীর্ণ হয়।

(খ) বৈদেশিক আক্রমণ :

ফরাসি রাজা ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের পর ইউরোপের রাজতান্ত্রিক দেশগুলি (অস্ট্রিয়া , প্রাশিয়া , ইংল্যান্ড , স্পেন) ফ্রান্স বিরোধী শক্তিজোট গঠন করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে এবং ফ্রান্স ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ।

(গ) সরকারে বিরোধিতা :

জনসাধারণের একবৃহদংশ তখন প্রকাশ্যে প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরোধিতা করতে থাকে, সরকারি আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে এবং কর প্রদানে ও সেনাদলে যোগদানে অসম্মত হয়। বিদেশি গুপ্তচরে দেশ ছেয়ে যায়।

(ঘ) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি :

ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও তখন চলছে চরম অরাজকতা ও প্রতি-বিপ্লবী আন্দোলন। চরম অন্নাভাব, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মহার্ঘতা ও অভাব এবং খাদ্যের সন্ধানে প্যারিসে বহিরাগতদের ভিড় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

(ঙ) রাজতন্ত্রের সমর্থনে বিদ্রোহ :

ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের (২১শে জানুয়ারি, ১৭৯৩ খ্রিঃ) ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। 

ইউরোপ-এর বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গ আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং তাঁরা বিপ্লবী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি শক্তিজোট গঠন করেন।

এছাড়া ফ্রান্সের ৮৩ টি প্রদেশ (ডিপার্টমেন্ট)-এর মধ্যে ৬০টি প্রদেশেই বিদ্রোহ শুরু হয়। লা ভেন্ডি-র বিদ্রোহী কৃষকদের সঙ্গে ক্ষুব্ধ যাজকরাও (ধর্মযাজকদের সংবিধানের জন্য) যোগ দেন।

ফ্রান্সের সন্ত্রাসের শাসনের গুরুত্ব বা ফলাফল :

ফ্রান্সের সন্ত্রাসের শাসনের গুরুত্ব বা ফলাফলকে আমরা মূলত দুটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি । যথা – সুফল ও কুফল ।

ফ্রান্সের সন্ত্রাসের শাসনের সুফল :

ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল একটি আপৎকালীন স্বৈরতন্ত্র’। সন্ত্রাসের শাসনের সুফলগুলি নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়‌। যেমন –

(১) ফ্রান্সের নিরাপত্তা :

বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ফ্রান্সে যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল সন্ত্রাসের শাসন প্রাথমিকভাবে সেই অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে ফরাসি জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়েছিল।

(২) সুগঠিত সেনাবাহিনী তৈরি :

বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ এবং আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য সন্ত্রাসের সংগঠকেরা একটি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেছিল।

এর ফলে ফ্রান্সের সৈন্যসংখ্যা অল্প সময়ের মধ্যেই ১০ লক্ষ অতিক্রম করে। সন্ত্রাসের কঠোর শাসন এই সেনাবাহিনীর মধ্যে গভীর জাতীয়তাবােধ ও কঠোর শৃঙ্খলা সঞ্চারিত করেছিল।

(৩) অর্থনৈতিক সংস্কারসাধন :

ঐতিহাসিক লেফেভর (Lefebvre), মাতিয়ে (Mathiez) প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়ােজন ছিল।

তাদের মতে সন্ত্রাসের শাসনের জন্যই ফ্রান্সে কালােবাজারি দমন, সর্বোচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ন্যায্য হারে কর আদায় ইত্যাদি সম্ভব হয়েছিল।

(৪) কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি :

সন্ত্রাসের সংগঠকেরা দেশত্যাগী অভিজাতদের জমিগুলি দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করেন এবং সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে গতিশীলতা করেছিলেন।

(৫) বিপ্লবকে রক্ষা :

সন্ত্রাসের সংগঠকেরা সন্দেহের আইন’ ও নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে ভয়াবহ ধ্বংসের হাত থেকে বিপ্লবকে রক্ষা করেছিল। এই কারণে ঐতিহাসিক টেলর (Taylor) বলেছেন, সন্ত্রাস বিপ্লবকে রক্ষা করেছিল’ (The Terror saved the Revolution)।

ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্বের কুফল :

সন্ত্রাসের শাসনের নানা কুফলও ছিল বলে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন। যেমন –

(১) ক্ষমতার অপপ্রয়োগ :

ঐতিহাসিক তেইন (Taine) মনে করেন, সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল মূলত ক্ষমতালােভী, সুবিধাভােগী ও দুর্বিনীত এক শ্রেণির মানুষের ক্রিয়াকলাপ।

তার মতে, সন্ত্রাসের শাসনে নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না, কারণ কেবল সন্দেহের বশেই বিনা বিচারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।

বলা হয়, “সন্ত্রাস দিয়ে বিপ্লব তার নিজের সন্তানদের গিলে ফেলে।

(২) কৃষক ও মেহনতি মানুষের হত্যা :

ডেভিড থমসনের (David Thomson) মতে, সন্ত্রাসের শাসনে নিহত মানুষের ৭০%-ই ছিল কৃষক ও মেহনতি মানুষ। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, সন্ত্রাসের রাজত্বকালে ফ্রান্সে চলেছিল কসাই বৃত্তির ঘৃণ্য মহামারি।

(৩) ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত :

এই সময়কালে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জীবনের নিরাপত্তা ছিল না। রােবসপিয়র গির্জাকে যুক্তির মন্দির’ বলে তুলে ধরেন।

(৪) বিপ্লবকে পঙ্গু করা :

সন্ত্রাসের সংগঠকদের কার্যকলাপ ক্রমশ ফ্রান্সের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তাই লুই ব্ল্যাঙ্ক-এর মতে “সন্ত্রাস বিপ্লবকে রক্ষা করেনি, সন্ত্রাস বিপ্লবকে পঙ্গু করে দেয়।”

সন্ত্রাসের শাসনের অবসান :

  • (১) ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুনে সেনাপতি জর্ডানের যুদ্ধজয়ের পর বিদেশি আক্রমণের সম্ভাবনা একরকম মুছে গিয়েছিল। এছাড়া লিয়ঁ, মার্সেই, তুলোঁ-র বিদ্রোহও দমিত হয়েছিল। এইসব কারণে আর সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল না।
  • (২) ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই সময় রোবসপিয়র কেবলমাত্র সন্ত্রাসকে অব্যাহতই রাখলেন না, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত ও কঠোরতর করেন।
  • (৩) ১০ই জুন ‘প্রেইরিয়াল’ নামে এক আইন পাস করে বিচারালয়ের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়। ন্যাশনালকনভেনশনের সদস্যরাও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হারান। এর ফলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
  • (৪) জেকোবিন, জিরণ্ডিন ও মধ্যপন্থী দলের আতঙ্কিত সদস্যরা সমবেতভাবে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে। পরদিন রোবসপিয়র-সহ তাঁর চব্বিশজন অনুগামীকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়।
  • (৫) নতুন বিপ্লবী বর্ষপঞ্জী অনুসারে ৯ই থার্মিডোর (২৭শে সেপ্টেম্বর) রোবসপিয়র ক্ষমতাচ্যুত হন। ধার্মিডোর মাসে এই ঘটনা ঘটেছিল বলে একে ‘থার্মিডোরীয় প্রতিক্রিয়া‘বলা হয়। রোবসপিয়রের মৃত্যুতে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে।

সন্ত্রাসের শাসনের প্রকৃতি :

  • (১) সন্ত্রাসের রাজত্বের মধ্যে কোনও শ্রেণি-সংঘর্ষের চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে প্রাণ দেন সব শ্রেণির মানুষ এমনকী সন্ত্রাস পরিচালনার নেতৃবর্গও। গিলোটিনে প্রাণ দেওয়া মানুষের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির মানুষরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
  • (২) লেফেভর ও কোবান বলেন যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৮৫ জনই ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। যাজক ও অভিজাতদের মধ্যে যথাক্রমে ৬.৫ এবং ৮.৫ শতাংশ গিলোটিনে প্রাণ দেন। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, সন্ত্রাসে নিহতদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল কৃষক ও মেহনতি মানুষ।

মূল্যায়ন :

পরিশেষে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ফ্রান্সে সন্ত্রাসের মতাে কঠোর শাসনের প্রয়ােজন ছিল, কিন্তু ‘মহাসন্ত্রাস’ ছিল অপ্রয়ােজনীয়।

যুদ্ধের অবসানে যখন সন্ত্রাসের কঠোরতা হ্রাসের প্রয়ােজন ছিল তখন রােবসপিয়র ‘লাল সন্ত্রাস’ চালু করে দেশে নতুন করে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিলেন।

তাই বলা যায়, সন্ত্রাসের শাসন ছিল ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলের সমষ্টি।

আরো পড়ুন – হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি

FAQs On ফ্রান্সের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্বের গুরুত্ব

সন্ত্রাসের শাসন বলতে কী বোঝো ।

ফ্রান্সে রােবসপিয়র-এর নেতৃত্বে জেকোবিন দল ১৭৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তা ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব বা সন্ত্রাসের শাসন (Reign of Terror) নামে পরিচিত। এই সন্ত্রাসের রাজত্ব ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত মােট ১৩ মাস ধরে চলেছিল।

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন কার নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল ?

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন রোবসপিয়ারের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন সংঘটিত হয়েছিল কোন বছর ?

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন সংঘটিত হয়েছিল ১৭৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে ।

মন্তব্য করুন