খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধের উত্থানের কারণ

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধের উত্থানের কারণ – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধের উত্থানের কারণ নিয়ে ।

আরো পড়ুন – ঠান্ডা লড়াই এর কারণ ও ফলাফল

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধের উত্থানের কারণ

ভূমিকা :

বৌদ্ধ ও জৈন্য গ্রন্থ এবং হিন্দু পুরান থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অস্তিত্ব ছিল না। উত্তর ভারতে এই সময়ে ছোটো বড়ো ১৬ টি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল । যাদের একত্রে ‘ষোড়শ মহাজনপদ ‘ বলা হয় । ষোড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলি সর্বদা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শক্তি ক্ষয় করতো । এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দিয়ে অবশেষে মগধকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে মহাজনপদ গড়ে ওঠে ।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধের উত্থানের কারণ :

বিম্বিসারের রাজত্বকালে মগধের অগ্রগতির ইতিহাসের সূচনা হয়এবং অশোকের কলিঙ্গ জয়ের মাধ্যমে সেই অগ্রগতির সমাপ্তি ঘটে। কয়েক শতাব্দী ধরে মগধ রাজ্যটি ছিল উত্তর ভারতের কেন্দ্রস্থল। তবে মগধের উত্থান কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। এর মূলে ছিল বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান ছিল যথা –

(ক) ভৌগলিক সুবিধা :

উত্তর-পূর্ব ভারতের উর্বর গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত মগধ কৃষিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। এই অঞ্চলের উর্বর মাটি এবং গঙ্গার মতো নদী থেকে প্রচুর জল সরবরাহ একটি শক্তিশালী কৃষি ভিত্তি প্রদান করে, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদনকে সমর্থন করে।

(খ) অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ : 

অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ মগধের উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল। মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ ছিল পাঁচটি পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত। 

অপর রাজধানী পাটলিপুত্র ছিল জলদুর্গ গঙ্গা,শোন ও গণ্ডক নদীর সঙ্গমস্থলে । মগধের পূর্বদিকে গহন অরণ্য থাকার ফলে শত্রুর কাছে তা দুর্গম ছিল।

(গ) উপযুক্ত রাজন্যবর্গ :

রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মগধের সিংহাসনে একাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন শাসকের আবির্ভাব মগধের উত্থানকে প্রশস্ত করেছিল । প্রতিটি রাজবংশেরই শাসকদের মূলনীতি ছিল মগধের বিস্তার। 

হর্যঙ্ক বংশের বিম্বিসার , অজাতশত্রু, মহাপদ্মনন্দ ও পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোকের মতো প্রতিভাসম্পন্ন নৃপতি মগধের উত্থানকে সুনিশ্চিত করেছিল ।

(ঘ) খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য :

মগধের সমৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মগধের খনিজ সম্পদ। মগধের লোহার খনিগুলি ছিল তার সামরিক শক্তির গর্ভগৃহ। মগধ এই লোহার খনিগুলির ওপর একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করে। 

মগধের উন্নত কৃষি, লোকবল, তার অরণ্য সম্পদ এবং খনিজ সম্পদ মগধকে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় অসাধারণ শক্তিশালী করে তুলেছিল। শক্তিশালী হওয়ার ফলে মগধ ক্রমে আগ্রাসী হয়ে ওঠে।

(ঙ) গোঁড়াপন্থী ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব মুক্ত :

দীর্ঘকাল যাবৎ মগধ আর্য আক্রমণের গণ্ডি থেকে দূরে থাকায় গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিধিনিষেধ এই অঞ্চলে বিশেষ ছিল না। এই অবস্থায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সার্বজনীন আবেদন এই অঞ্চলের মানুষের মনে রাজনৈতিক ভাবধারার সম্প্রসারণ ঘটায়। 

মগধ এই রাজনৈতিক ভাবধারার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মগধের জনগণ এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের অভ্যুত্থান মগধে এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য গঠনের সহায়ক হয়।

(চ) গঙ্গা নদীর ভূমিকা :

গঙ্গা বিধৌত অঞ্চলে নদীভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য মগধের সমৃদ্ধির সহায়ক হয়। গঙ্গা নদী ও তার শাখা নদীগুলি যথা দক্ষিণে শোন এবং উত্তরে ঘর্ঘরা ও গণ্ডক মগধের প্রতিরক্ষা সহায়ক হয়েছিল।

(ছ) মিশ্র সংস্কৃতি :

আর্য ও অনার্যের সংমিশ্রণে মগধের উদার ও উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠে । আর্য মানসিকতা ও অনার্য বাহুবলের সংমিশ্রনে মগধের উত্থান দ্রুত হয় ।

(জ) রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ : 

মগধের শাসকরা একটি কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন । তারা প্রশাসনিক সংস্কারকে বাস্তবায়িত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন ।

এছাড়াও একটি সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র গঠন করেছিলেন, যা দক্ষ শাসন ব্যবস্থাকে সহজতর করেছিল ।

ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতির কার্যকরের ক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধা প্রদানকারী হিসাবে গণ্য।

(ঝ) কূটনৈতিক কৌশল : 

মগধ তার প্রভাব বিস্তারের জন্য দক্ষ কূটনীতি এবং রাজনৈতিক কূটকৌশলকে কাজে লাগিয়েছিল ।

মগধের শাসকরা জোটবদ্ধ হয়ে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সাথে কৌশলগত ভাবে বিবাদের সমাধানের মাধ্যমে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিল ।

(ঞ) বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র : 

মগধ বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নালন্দা এবং তক্ষশীলার মতো বিখ্যাত শিক্ষা কেন্দ্রগুলি দূর-দূরান্ত থেকে পণ্ডিত ও ছাত্রদের আকৃষ্ট করেছিল।

পণ্ডিত, দার্শনিক এবং ধর্মীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা মগধের খ্যাতি এবং প্রভাবকে বাড়িয়েছিল, যা অনেক ক্ষেত্রেই মগধের উত্থানকে প্রশস্ত করেছিল ।

(ট) প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলির দুর্বলতা: 

মগধের সম্প্রসারণ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলির আপেক্ষিক দুর্বলতার দ্বারা সহজতর হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলির মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মগধকে তার আধিপত্য বিস্তার করার এবং এই অঞ্চলগুলিকে তার সাম্রাজ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ প্রদান করে।

(ঠ) সামরিক শক্তি : 

মগধ একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। মগধের শাসকরা হাতির ব্যবহার, সুপ্রশিক্ষিত পদাতিক বাহিনী এবং কৌশলগত জোট সহ উন্নত যুদ্ধ কৌশল আয়ত্ত করেছিল।

তারা ক্রমাগত তাদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছিল এবং প্রতিবেশী অঞ্চলগুলিকে জয় করতে এবং তাদের সাম্রাজ্য প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

(ড) বৈদেশিক বাণিজ্য :

জলপথ অর্থাৎনদীগুলির ওপর একছত্র আধিপত্য থাকার ফলে মগধ অতি সহজে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখত ।

গঙ্গানদীর মাধ্যমে জলপথে মগধের বৈদেশিক বাণিজ্য চলত।স্থলপথে মগধের বণিকগণ কাশ্মীর, গান্ধার প্রভৃতি অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করত।

এই বৈদেশিক বাণিজ্য মগধের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তার উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।

(ঢ) জনসংখ্যার অনুকূল পরিবেশ :

গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে মগধের অবস্থান মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলেছিল ।

পলিমাটি সমৃদ্ধ উর্বর কৃষিভূমি মগধকে জনবহল করে তুলতে সাহায্য করেছিল । জনবহুল হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রুচুর লোকবলের সুবিধা ছিল ।

নন্দ বংশের রাজা ধননন্দের বিপুল সেনাবাহিনী আলেকজান্ডারের মতো দিগ্বিজয়ী বীরের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।

মূল্যায়ন :

ভৌগোলিক সুবিধা, সামরিক শক্তি, রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, কূটনীতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মগধ তার সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করতে এবং নিজেকে প্রাচীন ভারতে একটি বিশিষ্ট শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

আরো পড়ুন – হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

FAQs On মগধের উত্থানের কারণ

মগধ কোথায় অবস্থিত ছিল?

মগধ উত্তর-পূর্ব ভারতের উর্বর গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত ছিল।

ষোড়শ মহাজনপদ বলতে কী বোঝো ।

বৌদ্ধ ও জৈন্য গ্রন্থ এবং হিন্দু পুরান থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অস্তিত্ব ছিল না। উত্তর ভারতে এই সময়ে ছোটো বড়ো ১৬ টি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল । যাদের একত্রে ‘ষোড়শ মহাজনপদ ‘ বলা হয় ।

মগধের একটি উল্লেখযোগ্য ভৌগলিক সুবিধা কী ছিল?

মগধের উর্বর মাটি এবং গঙ্গার মতো নদী থেকে জল সরবরাহের কারণে কৃষি সম্পদের সুবিধা হয়েছিল ।

মন্তব্য করুন