ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফলগুলি নিয়ে ।

এই পৃষ্ঠায়

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল

আরো পড়ুন – টেনিস কোর্টের শপথ কী

ভূমিকা :

1830 খ্রি: সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ রাজবংশের পরিবর্তে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ এবং তাঁর নেতৃত্বে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু ১৮ বছরের মধ্যেই ১৮৪৮ –এর ফেব্রুয়ারি মাসে আর এক অভ্যুত্থানে এই জুলাই রাজতন্ত্রের ও পতন হয়, ফলে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ :

বিভিন্ন ঐতিহাসিক ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেছেন। সেগুলি হল নিম্নরূপ –

(ক) রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধিতা :

প্রথম থেকেই লুই ফিলিপ ফ্রান্সের কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাননি । [i] বামপন্থী প্রজাতান্ত্রিক দল ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলি জুলাই রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধী ছিল । [ii] দক্ষিণপন্থী ন্যায্য অধিকার সমর্থকরা ফ্রান্সের সিংহাসনে লুই ফিলিপের অধিকারকে অবৈধ বলে মনে করত । [iii] মধ্যপন্থীরা লুই ফিলিপের মধ্যপন্থা নীতি ও শ্রমিককল্যাণবিরোধী নীতিতে এবং বোনাপার্টিস্টরা লুই ফিলিপের অগৌরবজনক পররাষ্ট্রনীতিতে হতাশ হয় ।

(খ) ত্রুটিপুর্ণ বিদেশনীতি :

লুই ফিলিপ যে-কোনো মূল্যে বৈদেশিক যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তি রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি-
[i] পোল্যান্ড ও ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিরপেক্ষ থাকেন,
[ii] বেলজিয়ামের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণে ব্যর্থ হন,
[iii] মিশর ও তুরস্কের বিরোধে ভুল নীতি গ্রহণ করেন,
[iv] আফ্রিকা ও নিকট প্রাচ্যে ভুল বিদেশনীতি গ্রহণ করেন।
এরূপ দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় বিদেশনীতি দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করে। জনগন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে সামিল হন।

(গ) জনসমর্থনের অভাব :

যেসব কারণে লুই ফিলিপের জনসমর্থনের অভাব ছিল।সেগুলি হল নিম্নরূপ –
[i] নেপোলিয়ন ঘনিষ্টরা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র লুই বোনাপার্টকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিল।
[ii] ন্যায্য অধিকার নীতির সমর্থকরা দশম চার্লসের উত্তরাধিকারী ডিউক অব বেরিকে সিংহাসনের বৈধ দাবিদার বলে মনে করতেন।
[iii] ক্যাথলিকরা লুই ফিলিপের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির এবং প্রজাতন্ত্রীরা রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধী ছিল ।

(ঘ) বুর্জোয়া রাজতন্ত্র :

লুই ফিলিপ মূলত বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষা করে শাসনকার্য চালাতেন। [i]তাঁর শাসনব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত,ভূস্বামী,বণিক ও শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষিত হতো । [ii] প্রতিনিধি সভার সদস্য হওয়ার ও ভোটদানের অধিকার কেবলমাত্র বিত্তশালী শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন তিনি ।এইভাবে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্থাপিত হয় গোষ্ঠীতন্ত্র ।

[ঙ] লুই ফিলিপের স্বৈরাচারী নীতি :

জুলাই বিপ্লবের ফলে লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সাংবিধানিক রাজা হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন ।কিন্তু বাস্তবে তিনি স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন ।এর পরিনাম হিসাবে ফ্রান্সের জনগণ হতাশ হয়ে পড়ে এবং তারা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের পথ বেছে নেয় ।

[চ] শ্রমিক অসন্তোষ :

ফ্রান্সে শ্রমিক শ্রেণি অত্যন্ত দূরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাত। লুই ফিলিপ শ্রমিক কল্যাণমূলক কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে শ্রমিকশ্রেণি প্রজাতন্ত্রীদের সঙ্গে যােগ দিয়ে বিদ্রোহের জন্য গুপ্তসমিতি গঠন করে।লুই ব্লা, সাঁ সিমোঁ প্রমুুুখ সমাজতান্ত্রিক নেতা শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে এগিয়ে আসেন।

[ছ] অর্থনৈতিক সংকট :

[i] ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৮৪৪-১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে পরপর কয়েক বছরের অজন্মা, খরা ও শস্যহানির ফলে ফ্রান্সে প্রবল খাদ্য সংকট দেখা দেয়। [ii]  ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় ১৮৪৭-১৮৪৮ সালে রুটির দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে মন্দা দেখা দেয়, বেকার সমস্যা শুরু হয় এবং কর্মহীন কৃষক ও শ্রমিকদের দারিদ্র্যতা চরমে পৌঁছায়। [iii] আর্থিক সমস্যা সমাধানে অক্ষম সরকারের পতন ঘটাতে মানুষ তৎপর হয়ে ওঠে। দেশের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয়। লা-ভেণ্ডি ও প্রোভেন্সে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের সমর্থকরা, বোলন ও স্ট্রাসবার্গে বোনাপার্টিস্টরা এবং প্যারিস, লিয়ঁ প্রভৃতি শহরে শ্রমিকরা বিদ্রোহ শুরু করে। [iv] লুই ফিলিপ কাঠোর দমননীতির মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করায় বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। [v] জ্যাক ড্রজ অবশ্য এই আর্থ-সামাজিক কারণ মানতে রাজি নন। তাঁর মতে, আর্থ-সামাজিক কারণে বিপ্লব হলে তা ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দেই সংঘটিত হত,পরে নয়। তাঁর মতে, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে মন্দা কেটে যায়। কোবানও তাই মনে করেন। [vi] জ্যাক ড্রজ আরো বলেন যে, লুই ফিলিপ বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করতে সচেষ্ট হলে এক শ্রেণির সঙ্গে অপর শ্রেণির দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই শ্রেণিবৈষম্য বা দ্বন্দ্বই বিপ্লবের মূল কারণ।

(জ) প্রত্যক্ষ কারণ ও বিপ্লবের সূচনা :

১৮৪৮ খ্রি: ২২ ফেব্রুয়ারি ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে প্যারিসের ময়দানে এক কেন্দ্রীয় সমাবেশের আয়োজন করা হয় ।প্রধানমন্ত্রী গিজো এই সমাবেশকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন ।ক্ষুব্ধ জনতা গিজার বাসভবন আক্রমণ করলে তাঁর দেহরক্ষীর গুলিতে ২৩ জন নিহত হয় ।এই ঘটনার প্রত্যুত্তরে বিক্ষুব্ধ জনতা অবিলম্বে লুই ফিলিপের পদত্যাগ দাবি করে । লুই ফিলিপ তাঁর পৌত্রের হাতে দায়িত্বভার চাপিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়ে গেলে রাজতন্ত্রের অবসান হয় ।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বিভিন্ন ফলাফলগুলি হল নিম্নরূপ –

(ক) রাজতন্ত্রের অবসান :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের জয় ঘোষিত হয়। লা-মার্টিন এই অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ফ্রান্সের জাতীয় সভার ১০ জন সদস্যকে নিয়ে একটি কার্যনির্বাহক সমিতি গঠিত হয়।

(খ) মেটারনিকতন্ত্রের অবসান :

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা সম্মেলনের পর থেকে অস্ট্রিয়া-সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রিন্স মেটারনিকের নেতৃত্বে যে মেটারনিকতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে তার অবসান ঘটেছিল। 

(গ) ইতালি ও জার্মানির ঐক্য :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সরাসরি ইতালি ও জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হলেও এই বিপ্লব ভবিষ্যতে এই রাষ্ট্র দুটির ঐক্যের পথ মসৃণ করেছিল।

(ঘ) সাধারণ বুর্জোয়াদের ক্ষমতা লাভ :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব একেবারে ব্যর্থ হয় নি। ফ্রান্সে স্বৈরশাসন ফিরে এলেও সার্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি স্বীকৃতি লাভ করে এবং ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ফলে নিম্নবিত্ত সাধারণ বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে।

(ঙ) শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি :

শ্রমিক শ্রেণির উন্নতির জন্য শ্রম কমিশন গঠিত হয়। তাদের কাজের সময় সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়-স্থির হয় যে প্যারিসে দশ ঘন্টা এবং প্রদেশগুলিতে শ্রমিকরা এগারো ঘন্টা করে কাজ করবে।

(চ) সামন্ততন্ত্রের অবসান :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের পতন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ইউরোপ থেকে ভুমিদাস প্রথাও লুপ্ত হতে থাকে।

(ছ) জাতীয় কর্মশালা প্রতিষ্ঠা :

সকলের জন্য কাজের অধিকার বা Right of Work স্বীকার করা হয়। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য জাতীয় কর্মশালা স্থাপিত হয়।

মূল্যায়ন :

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্তের অবসান ঘটে । ফ্রান্সের বাইরে ইতালি,জার্মানি,অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে । এই বিপ্লবের ফলে ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্রের অবসান ঘটে । এককথায় বলতে গেলে ইউরোপের পুরাতনতন্ত্রের পতন ত্বরান্বিত হয় ।

আরো পড়ুন – ফরাসি বিপ্লবের কারণ

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

FAQs On – ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল

কবে কোথায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংঘটিত হয়?

২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা কে ছিলেন?

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা ছিলেন লুই ফিলিপ ।

কোন বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে দ্বিতীয় বার প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়?

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে দ্বিতীয় বার প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয় ।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের নেতা কারা ছিলেন?

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের নেতা ছিলেন থিয়ার্স, লা মার্টিন প্রমুখ ।

মন্তব্য করুন