নৌবিদ্রোহের কারণ আলোচনা করো – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম নৌবিদ্রোহের কারণগুলি নিয়ে ।
এই পৃষ্ঠায়
- 1 নৌবিদ্রোহের কারণ আলোচনা করো :
- 2 ভূমিকা :
- 3 নৌবিদ্রোহের কারণ :
- 3.1 (ক) আই. এন. এ. সেনাদের বিচার :
- 3.2 (খ) নৌসেনাদের বেতন বৈষম্য :
- 3.3 (গ) ব্রিটিশ কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার :
- 3.4 (ঘ) নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ :
- 3.5 (ঙ) পদোন্নতির অভাব :
- 3.6 (চ) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ :
- 3.7 (ছ) সেনা ছাঁটাই :
- 3.8 (জ) বিপজ্জনক কেন্দ্রে নিয়োগ :
- 3.9 (ঝ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব :
- 3.10 (ঞ) অভ্যন্তরীন ঘটনাবলি :
- 4 নৌবিদ্রোহের সূচনা :
- 5 নৌবিদ্রোহের প্রসার :
- 6 স্ট্রাইক কমিটির দাবি :
- 7 নৌবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ :
- 8 নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব :
- 9 মূল্যায়ন :
- 10 FAQs On – নৌবিদ্রোহের কারণ আলোচনা করো
নৌবিদ্রোহের কারণ আলোচনা করো :
আরো পড়ুন – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো
ভূমিকা :
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষপর্বে উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম হল নৌবিদ্রোহ। আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ভারতীয় নৌসেনাদের বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা জোগায়।ড. সুমিত সরকারের মতে, এই বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বীরোচিত সংগ্রাম।
নৌবিদ্রোহের কারণ :
নৌবিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত কারণ ছিল সেগুলি নিম্নে আলোচিত হল –
(ক) আই. এন. এ. সেনাদের বিচার :
আই. এন. এ.-র প্রধান তিন সেনাপতি প্রেম সেহগল, শাহনওয়াজ খান এবং গুরবক্স সিং ধিলনকে বিচারের জন্য দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এবং প্রায় দুই মাস ধরে তাদের বিরুদ্ধে চলা মামলায় আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কাহিনি প্রকাশিত হয়। এতে ভারতীয় নৌসেনারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
(খ) নৌসেনাদের বেতন বৈষম্য :
সমযোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয় নৌকর্মচারীদের ব্রিটিশ কর্মচারীদের থেকে কম বেতন দেওয়া হত। আবার তাদের পদোন্নতিরও কোনোরকম ব্যবস্থা ছিল না।
চাকরির মেয়াদ শেষে ভারতীয় নৌসেনাদের পুনর্বাসনেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে ভারতীয় নৌসেনার ক্ষুব্ধ হয় এবং বিদ্রোহের পথ বেছে নেয় ।
(গ) ব্রিটিশ কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার :
নৌসেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ নৌ-অফিসাররা ভারতীয় নৌকর্মচারীদের অকারণে গালিগালাজ, অপমান ও তাদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করত। ফলে অপমানিত নৌসেনারা বিদ্রোহী হয়।
(ঘ) নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ :
নৌবাহিনীর ভারতীয় কর্মীদের নিকৃষ্ট আহার দেওয়া হতো। বহুবার আবেদন করেও এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি, এই কারণে ভারতীয় নৌবাহিনীতে অনেক আগে থেকে অসন্তোষ ছিল।
(ঙ) পদোন্নতির অভাব :
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌসেনাদের পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হত ।ফলে তারা বিদ্রোহের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় ।
(চ) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ :
ভারতীয় নৌ-সেনাদের উপযুক্ত বসবাসের ব্যবস্থা ব্রিটিশ অফিসারদের দ্বারা করা হতো না ।তারা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করত।
(ছ) সেনা ছাঁটাই :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর নৌসেনাদের ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের বিনা কারণে বরখাস্ত করা হলে তারা বিদ্রোহের পথে হাটতে বাধ্য হয় ।
(জ) বিপজ্জনক কেন্দ্রে নিয়োগ :
ভারতীয় নৌসেনাদের অনিচ্ছা সত্বেও তাদেরকে বিপজ্জনক অঞ্চলে নিয়োগ করা হত।
(ঝ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে নৌসেনাদের ছাঁটাই করা শুরু হয়। এতে বেকার ভারতীয় নৌসেনারা আর্থিকভাবে বিপদের মুখে পড়ে ক্ষুব্ধ হয় এবং তারা বিদ্রোহের পথে হাটতে বাধ্য হয় ।
(ঞ) অভ্যন্তরীন ঘটনাবলি :
দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত হওয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, পুলিশ ও বিমান বাহিনীর ধর্মঘট ইত্যাদি ঘটনা ভারতীয় নাবিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
নৌবিদ্রোহের সূচনা :
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বোম্বাই বন্দরে রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির ‘তলােয়ার’ জাহাজের রেডিয়াে অপারেটর বলাই দত্ত স্লোগান লেখেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘British Quit India’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘জয়হিন্দ’ ইত্যাদি।
এই অপরাধে নৌকর্তৃপক্ষ বলাই দত্তকে পদচ্যুত করে। এর প্রতিবাদে রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান এম. এস. খানের নেতৃত্বে ১৫০০ নাবিক বিদ্রোহ ঘােষণা করে (১৮ ফেব্রুয়ারি)।
বােম্বাইয়ের ২২টি জাহাজে এবং করাচির হিন্দুস্থান জাহাজে এই বিদ্রোহের সূচনা ঘটে।
নৌবিদ্রোহের প্রসার :
(ক) বোম্বাইয়ের ‘তলোয়ার’ নামক জাহাজে প্রথম নৌবিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমে তা আরও ২২টি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে।
(খ) ১৯শে ফেব্রুয়ারি তারা ব্রিটিশ পতাকা‘ইউনিয়ন জ্যাক’ নামিয়ে জাহাজে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির তিনটি পতাকা তুলে দেয়।
(গ) ‘রয়াল ইণ্ডিয়ান নেভি’-র নাম রাখে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি’ এবং ঘোষণা করে যে, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া তারা অন্য কারো আদেশ মানবে না।
(ঘ) এরপর দ্রুত তা করাচি, কলকাতা, মাদ্রাজ, কোচিন, জামনগর, চট্টগ্রাম, বিশাখাপত্তনম, আন্দামান প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
(ঙ) বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি গঠিত হয়। দেশের ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষ বিদ্রোহীদের সমর্থন করে ধর্মঘটে সামিল হয়। বিভিন্ন সংঘর্ষে প্রায় ৩০০ লোক নিহত এবং ২ হাজার জন আহত হয়।
স্ট্রাইক কমিটির দাবি :
নৌ সংগ্রাম পরিচালনা ও বিভিন্ন বিদ্রোহী কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বিদ্রোহীরা একজোট হয়ে কেন্দ্রীয় ধর্মঘট সমিতি গঠন করে।
এই কমিটির প্রেসিডেন্ট হন এম. এস. খান, ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন মদন সিং। স্ট্রাইক কমিটি বেশ কিছু দাবি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে। এই দাবিগুলি হল-
- (ক) আই. এন. এ. সেনাদের ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে ।
- (খ) ভারতীয় নৌসেনাদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- (গ) নৌসেনাদের জন্য উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে ।
- (ঘ) ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আন্তে হবে ।
- (ঙ) ব্রিটিশ ও ভারতীয় নাবিকদের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে ।
নৌবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ :
অল্প সময়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে ছিল। এই ব্যার্থতার কারণগুলি হল নিম্নরূপ –
- (ক) জাতীয় নেতাদের বিরোধিতা : কংগ্রেসের অনেক নেতা এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে নি। নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, গান্ধিজি প্রমুখ নেতা বিদ্রোহীদের সমালোচনা করেন। সম্ভবত তাঁরা জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার ভয় পাচ্ছিলেন।
- (খ) বিমান হানার ভয় : আকাশ থেকে বিমান হানার ভয় ও জাতীয় নেতাদের চাপ আন্দোলনকে দুর্বল করে দে।
- (গ) বল্লভভাই এর মধ্যস্ততা : সর্দার প্যাটেল সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব আনলে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে।
নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব :
১৯৪৬ খ্রি: সংঘটিত এই নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয় ।এই বিদ্রোহের গুরুত্বগুলি হল নিম্নরূপ –
- (ক) ব্রিটিশ ভীতির অবসান : নৌসেনাদের বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশ ভীতি দূর করতে সমর্থ হয়েছিল ।
- (খ) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য : নৌ বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতি যোগ দিয়েছিল । সুতরাং বলা যায় এই বিদ্রোহ হিন্দু মুসলিম ঐক্যের বিদ্রোহ ।
- (গ) মন্ত্রী মিশনের আগমন : ঐতিহাসিক রজনী পামদত্তের মতে, নৌবিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সঙ্গে আলোচনা করতে বিদ্রোহ শুরুর পরের দিনই মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
- (ঘ) ভারত ত্যাগের ভাবনা : ভারতে এমন আর একটি বিদ্রোহ শুরু হলে তার পরিণাম যে ভয়ংকর হবে একথা বুঝতে পারে ব্রিটিশ সরকার। ফলে শীঘ্রই তারা ভারত ত্যাগের কথা ভাবতে শুরু করে।
মূল্যায়ন :
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব একেবারেই অস্বীকার করা যায় না। সিপাহী বিদ্রোহের পর এতবড় বিদ্রোহ ভারতের অভ্যন্তরে আর কখনও সংঘটিত হয়নি।
এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার স্পষ্টতই বুঝতে পারে যে ভারতে তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাই ব্রিটিশ প্রশাসন শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল।
আরো পড়ুন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog
পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63
FAQs On – নৌবিদ্রোহের কারণ আলোচনা করো
নৌ বিদ্রোহ প্রথম বোম্বাইয়ের তলোয়ার জাহাজে শুরু হয় ।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি নৌ বিদ্রোহ হয়েছিল।
সরকার ও নৌবিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
নৌ বিদ্রোহ বোম্বাইয়ের তলোয়ার জাহাজে শুরু হয়েছিল ।