বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা – আজকের পর্বে আমরা তোমাদের সাথে আলোচনা করলাম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা নিয়ে ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

আরো পড়ুন – মাতঙ্গিনী হাজরা স্মরণীয় কেন

এই পৃষ্ঠায়

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা :

ভূমিকা :

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বাংলা প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করেন। একে বঙ্গভঙ্গ বলা হয়।

এই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলে বাংলা তথা ভারতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয় । নারীরাও ঘরের কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই আন্দোলনে দলে দলে অংশ গ্রহণ করেন । 

আন্দোলনে যুক্ত নারী নেতৃবৃন্দ :

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা হলেন – সরলাদেবী চৌধুরানী,কুমুদিনী দাস , লীলাবতী মিত্র , নির্মলা সরকার , হেমাঙ্গিনী দাস প্রমুখ।

আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা :

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল মূলত ঘরোয়া বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবুও পুরুষদের মতো মেয়েরাও গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে সভা-সমিতি করে দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্যাদি বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্যাদি ব্যবহারের আবেদন জানান।

ময়মনসিংহের মেয়েরাই সর্বপ্রথম সভা করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তাদের ভূমিকা নিম্নে আলোচিত হল –

(ক) অরন্ধন দিবস পালন :

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে যে রাখী বন্ধন উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাতে প্রবল উৎসাহে মেয়েরা অংশ গ্রহণ করেন

এবং কলকাতা সহ গ্রামে-গঞ্জের মন্দিরে, স্নানের ঘাটে সর্বত্র এই উৎসব ছড়িয়ে দেয় ।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে যে ‘অরন্ধন উপবাস দিবস’ পালিত হয় তাতেও মেয়েরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় ।

বঙ্গভঙ্গের দিন বিকালে দুই বাংলার ঐক্যের প্রতীক রূপে কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে যে মিলন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হয় তাতেও মেয়েরা শামিল হয় ।

(খ) বিদেশী দ্রব্য বর্জন :

দেশী আন্দোলনের অন্যতম ধারা বয়কটেও নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। বিদেশী শাড়ি, চুড়ি সহ রান্নাঘরে বিলাতি লবণ, মসলা ও বিদেশী ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করে, বিদেশি শিক্ষালয় ত্যাগ করে, বিদেশী পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং-এ অংশ নেয়।

কলকাতায় আয়োজিত এক মহিলা সভায় নাটোরের মহারানি বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান ।

নদীয়ার মঙ্গলগঞ্জের জমিদার লক্ষণচন্দ্র আসের বিধবাপত্নী, জলপাইগুড়িতে অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, ময়মনসিংহে পুষ্পলতা গুপ্তা, কাশীতে সুশীলা বসু, কলকাতায় হেমাঙ্গিনী দাস প্রমূখ নারী বিদেশি পণ্য বয়কট করার আহ্বান জানান ।

(গ) স্বদেশী দ্রব্য তৈরি ও ব্যবহারের আহ্বান :

বিদেশী দ্রব্য বর্জনের পাশাপাশি নারীরা স্বদেশী দ্রব্য তৈরি ও ব্যবহারের আহ্বান জানায় ।

স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখী সমিতি’ ও সরলাদেবী চৌধুরানী ‘লক্ষীরভাণ্ডার’ স্থাপন করেন ।

(ঘ) পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা :

নারীদের দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রিকা যেমন – সরলাদেবী চৌধুরানী সম্পাদিত ‘ভারতী’ সরযুবালা সম্পাদিত ‘ভারত মহিলা’ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।

স্বদেশি আন্দোলন চলাকালীন মুসলিম নারী খায়রুন্নেসা ‘নবনূর’ পত্রিকায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘স্বদেশানুরাগ’ নামে একটি কবিতা লিখে বাংলার নারীসমাজকে স্বাদেশিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করেন ।

তাই চারণ কবি মুকুন্দ দাস বাংলার নারী সমাজের উদ্দেশ্যে গান বাঁধেন “পরো না রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পরো না ।”

(ঙ) স্বদেশি তহবিলে দান :

অবলা বসুর উদ্যোগে মেরী কার্পেন্টার হলে প্রায় এক হাজার মহিলা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে শপথ নেয় । মহিলারা স্বদেশি পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার করার পাশাপাশি স্বদেশি তহবিলে টাকা পয়সা এমনকি সোনার গয়না পর্যন্ত দান করেন ।

(চ) সভা সমিতিতে যোগদান :

তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গনারীর গৃহ-প্রাকারের বাইরে যাওয়াই ছিল দুষ্কর।

এ সত্ত্বেও বহু মহিলা সেদিন সভা সমিতিতে যোগ দিতেন এমনকী অনেকে প্রকাশ্য সভায় ভাষণও দিতেন।

সংখ্যার দিক থেকে নগণ্যা হলেও, তাঁদের ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর নয়। জলপাইগুড়ির অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, ময়মনসিংহের পুণ্যলতা গুপ্তা, কাশীর সুশীলা বসুর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। 

(ছ) মা লক্ষীর ধারণার প্রচার :

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা দেবী লক্ষীকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করে। প্রচার করা হয় বঙ্গভঙ্গের জন্য মা লক্ষী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন,তাকে ফিরিয়ে আন্তে সকল নারীকে সচেষ্ট হতে হবে ।

(জ) মায়ের কৌটোয় অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ :

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অর্থগ্রহনের জন্য মায়ের কৌটোর কথা বলা হয়। মায়ের কৌটো বলতে বোঝায় প্রতি বাড়িতে একটি করে কৌটো রাখতে হবে ।

সেই কৌটোতে প্রতিদিন দেশমায়ের জন্য একমুঠো করে চাল রাখতে হবে। আবার কোনো নারী বেশি অর্থ দান করলে তাকে আবার বঙ্গলক্ষী উপাধি দেওয়ার চল শুরু হয়।

(ঝ) বিপ্লবীদের সহায়তা প্রদান :

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসার ঘটে । ভগিনী নিবেদিতা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন ।

তিনি সক্রিয় ভাবে বাংলার গুপ্তসমিতি অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।

বাংলাসহ বাংলার বাইরেও যেসব নারীরা বিপ্লবীদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কলকাতার বাইরে মুর্শিদাবাদের গিরিজা সুন্দরী,বরিশালের সরোজিনী দেবী, বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী,খুলনার লাবণ্যপ্রভা দত্ত,ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন প্রমুখ।

সীমাবদ্ধতা : 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাদের আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল —

(ক) উচ্চবর্গের নারীদের অংশগ্রহণ :

আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্গের বাঙালি হিন্দু পরিবারভুক্ত । কৃষক পরিবারের বা মুসলিম পরিবারের তেমন কোন নারী প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি ।

মুসলিম পরিবারের খায়রুন্নেসা অবশ্য ‘নবনূর’ নামক পত্রিকায় ‘স্বদেশানুরাগ’ নামক রচনা প্রকাশ করে স্বদেশী আন্দোলনের প্রসারে সচেষ্ট হন ।

(খ) শহুরে ও অভিজাত নারীদের অংশগ্রহণ :

আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা প্রায়ই সবাই ছিলেন শহুরে ও অভিজাত । গ্রামের সাধারণ মেয়েদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে ছিল না ।

(গ) পূর্ব নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত আন্দোলন :

সর্বোপরি নারীরা স্বাধীনভাবে এই আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেন নি, তাদের আন্দোলনসূচী ছিল পূর্ব নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত । 

(ঘ) পুরুষের প্রাধান্য :

এই আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও আন্দোলনের নীতি-পদ্ধতি নারীরা স্থির করতে পারতেন না। তা মূলত পুরুষ আন্দোলনকারীরাই স্থির করতেন।

(ঙ) সীমিত অংশগ্রহণ :

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও তা কখনোই খুব ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। নারীসমাজের সীমিত অংশই এই আন্দোলনে অংশ নেয়।

মূল্যায়ন :

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন মূলতঃ সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা।

নিম্নবিত্ত হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলাদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়নি। তা সত্ত্বেও ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী সমাজের এই স্বল্পতম ভূমিকা চোখে পড়ার মতাে।

আরো পড়ুন –একা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojog

জিকে সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন – www.youtube.com/@DRMonojogGK

পিডিএফ পেতে ভিজিট করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল – DR Monojog63

আরো জানতে পড়ুন – বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি কি

মন্তব্য করুন